নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় করোনার এই সংকটকালে দিনদিন বেড়েই চলেছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। গজারিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা মিলছে শিশুশ্রমিকদের। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্টিল ও কাঠের ফার্নিচারের দোকান, ভাঙ্গারীর দোকান, হোটেল রেস্তোরাঁ, ওয়েল্ডিং এর দোকান, কসমেটিকসের দোকান, ওষুধের ফার্মেসি, ব্যাটারির দোকান, গাড়ির গ্যারেজসহ বহুতল ইমারত নির্মাণ কাজেও দেখা যাচ্ছে এসব শিশু শ্রমিকরা নিয়োজিত রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, গজারিয়ার ভাটেরচর এলাকায় অতিরিক্ত মুনাফার আশায় শিশুশ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মদিনা ফরেন ফার্নিচার মার্ট এর কারখানায় এমন কতিপয় শিশুশ্রমিক রয়েছে যাদের বয়স প্রায় ৯ থেকে ১০ বছরের নিচে আবার কারো ১৩ কিংবা ১৪ হবে। সেখানে তাদের কাজে নেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শিশুদের দিয়ে অবাধে চলছে কেমিক্যাল মিক্সিং, ফার্নিচার শাইনিং ও বার্নিশিংয়ের মত ক্ষতিকারক কাজ। কেমিক্যাল জাতীয় এইসব ক্ষতিকারক পদার্থ স্প্রে আকারে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে তাদের দেহে ঢুকছে। এতে করে তাদের রয়েছে নানা ধরনের শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা। মদিনা ফরেন ফার্নিচার কারখানার শিশুশ্রমিকদের সঙ্গে কথার বলার এক পর্যায়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিশুশ্রমিক জানায় তার বাস্তবতার কথা। সে বলে, আমার বয়স (১২)। আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। আমরা ২ ভাই ১ বোন। হতদরিদ্র বাবা-মায়ের সন্তান। তাই বাধ্য হয়ে আমি পড়ালেখা ছেড়ে ফার্নিচারের দোকানে এসব কাজ শুরু করি। বেতনের কথা জানতে চাইলে সে বলে, মাসে ৫ হাজার টাকা পাই। এটা তো শারীরিক ক্ষতিকারক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, এ কাজ কেন করো এমন প্রশ্নের উত্তরে সে জানায়, অন্যান্য কাজের চেয়ে এ কাজে টাকা বেশি পাই তাই করি এবং আমিও ভালো করে চলতে পারি ও পরিবারকে কিছু টাকা দিতে পারি। এর মতো অনেক শিশু গজারিয়ার বিভিন্ন দোকানে শিশুশ্রমের কাজ করছে। বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি দেশ শিশুশ্রম বন্ধের ঘোষণা দিলেও আমাদের দেশে এটি প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। করোনাকালে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া শিশুর মাত্রা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে দিনদিন এই শিশুশ্রমিকের সংখ্যাও বাড়বে বলে অনেকেরই অভিমত। সচেতন মহল মনে করেন, বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ হলো দারিদ্রতা। আর আমাদের দেশে ৩১ দশমিক ৬ ভাগ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। এসব পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু আয় দৈনিক ৮০ টাকারও কম। এদের বেশিরভাগ পরিবার অস্বচ্ছল। ফলে এসব পরিবারের শিশুরা তাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য ছোট থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা শুরু করে। তাই তাদের নিজেদের আর পরিবারের খাওয়ার জন্য লেখাপড়ার পরিবর্তে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পিছপা হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তাদের এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে মোটর ওয়ার্কশপে কাজ, গ্রেন্ডিং ওয়েল্ডিং, গ্যাস কারখানা, লেদ মেশিন, রিকশা চালানো, বাস-ট্রাকের হেলপারি, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহ শিশু শ্রমিক, ইটভাঙা, ইটভাটা শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, স্টিলের আলমারির দোকানের শ্রমিকের কাজসহ সহজে মিলছে বিভিন্ন ধরনের কাজ। ফলে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জিয়াউল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে প্রায় ৩৮ ধরনের শিশুশ্রম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আজকের শিশুরা আগামীর ভবিষ্যৎ। যেসব শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তাদের সচেতনতার জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। তবে গজারিয়াতে শিশুশ্রম এ ধরনের অভিযোগ নেই। পাওয়া গেলে বিশেষ করে যেসব শিশুরা কম বয়সে এসব কাজে নেমে পড়ছে তাদের অভিভাবককে সচেতন করতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তারা যেন তাদের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে না পাঠায়। তিনি আরও বলেন, এসব ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে শিশুদের মুক্ত করতে না পারলে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সেই সাথে তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে। সরকারের একার পক্ষে শিশুশ্রম বন্ধ সম্ভব নয়। তাই শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিশুশ্রম বন্ধে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং যারা শিশুশ্রমিক নিয়োগ দিবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।