বিশেষ প্রতিবেদক
এবার গ্রীষ্মকালের শুরু থেকেই আশঙ্কাজনক হারে বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে প্রাণহানির ঘটনাও। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই দেশে গত কিছুদিন ধরে প্রতিদিনই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। আর তাতে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও প্রাণহানী ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশগুলোয় বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী গত এপ্রিলেই বজ্রপাতে ৬০ জনেরও বেশি মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের এপ্রিল মাসে যেখানে প্রাণহানির ঘটনা ছিল মাত্র ২১। আর সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর বজ্রপাতে আড়াইশ’ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। বর্তমানে সারাদেশেই কালবৈশাখী একের পর এক আঘাত হানছে। ফলে বজ্রপাতে প্রাণহানিও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞ এবং আবহাওয়া অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত কয়েকদিন ধরে সারাদেশেই বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। ঘন কালো মেঘে আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেখান থেকে হঠাৎ করেই তৈরি হচ্ছে বজ্রমেঘ। আর বজ্রমেঘ থেকেই হচ্ছে বজ্রপাত। বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। মৌসুম শুরু হলেই বজ্রপাতে প্রতিবছর কয়েকশ’ লোকের প্রাণ ঝড়ছে। এ বছর মৌসুম শুরু না হতেই বজ্রপাতের ঘনঘটা যেমন বেড়েছে, ফলে প্রাণহানিও আশঙ্কাজনক বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করে প্রাণহানি কমিয়ে আনার ওপর নজর দেয়া জরুরি। বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর পাশাপাশি বজ্রপাতেও প্রাণ ঝরছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। গ্রীষ্মকালে ওই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এমন পরিস্থিতির তৈরি হচ্ছে। যেসব এলাকায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, সেসব এলাকায় যে মেঘের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকেই বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকে। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। পৃথিবীর যে কয়েকটি অঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ তার মধ্যে দক্ষিণ-এশিয়া অন্যতম। তার মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতের হার যেমন বেশি, তেমনি প্রাণহানিও হচ্ছে বেশি। ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা বা নেপালে বজ্রপাত হলেও সেখানে মৃত্যুর হার এতো বেশি নয়।
সূত্র আরো জানায়, তাপমাত্রা গত বছরের মত এখনো সেভাবে বাড়েনি। সাধারণত এপ্রিল মাসে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরে বজ্রপাতের মৌসুম শেষ হতো। কিন্তু এবার বজ্রপাতের মৌসুম প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ মে মাসে শুরু হয়ে তা অক্টোবরের মাঝামাঝি গিয়ে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর মে, জুন ও জুলাই মাসে বজ্রপাতের পরিমাণ সাংঘাতিকভাবে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত যারা বজ্রপাতে মারা গেছে তাদের ৮৭ ভাগই সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের মানুষ। সেজন্য এখন ২/১ দিন পরপর কালবৈশাখী ঝড় হচ্ছে। বজ্রপাতের পূর্বাভাস জানার জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাডার স্থাপন করেছে। কিন্তু তাতে প্রাণহানি কমেনি। তবে হাওরাঞ্চলে ১/২ কিলোমিটার পরপর কিছু পাকা ঘর তৈরি করে দেয়া হলে কৃষকরা সেখানে আশ্রয় নিয়ে বাঁচার সুযোগ পেতে পারে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, তারপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা। কিছু দূরেই রয়েছে হিমালয়। সেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে। এই দুইটা বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। শীতের পর বঙ্গোপসাগর থেকে উষ্ণ বাতাস আসতে শুরু করে, অন্যদিকে হিমালয় থেকে আসে ঠান্ডা বাতাস। দক্ষিণের গরম আর উত্তরের ঠান্ডা বাতাসে অস্থিতিশীল বাতাস তৈরি হয় আর তার থেকে তৈরি হয় বজ্র মেঘের। এরকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রের তৈরি হয়। এরকম উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন সবচেয়ে কাছে যা পায় তাতেই আঘাত করে।