খুলনার অভিজ্ঞতায় আগামীর কৌশল কষছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি
আওয়ামী লীগ মনে করছে, খুলনার অভিজ্ঞতা গাজীপুরে কৌশল প্রণয়নে সহায়ক হয়েছে।
এর মোকাবিলার কৌশল নিয়ে ভাবছে বিএনপি।
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আগামী নির্বাচনের পরিকল্পনা কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। এই নির্বাচনের পর সরকারি দল মনে করছে, ভালো প্রার্থী দিয়ে ভোটের মাঠে বিএনপিকে চাপে রাখতে পারলেই জয় নিশ্চিত।
অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে, আগামী জাতীয় সংসদ ও বাকি সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন কেমন হবে, তার একটা মহড়া ছিল খুলনার নির্বাচনে। খুলনায় আওয়ামী লীগ যে কৌশল অবলম্বন করেছে, তার মোকাবিলায় পাল্টা কৌশল নিয়ে ভাবছে বিএনপি।
আর নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, কুমিল্লা বা রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যে সুনাম অর্জন করেছিল, খুলনায় এসে তাতে ছেদ পড়েছে। ইসির কিছু পদক্ষেপ ও নির্লিপ্ততা প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
খুলনায় ১৫ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয় পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক।
এই নির্বাচনে ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। মারামারি না বাধিয়ে কেবল সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে এবং প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে ভোট নেওয়ার কৌশল দেখা গেছে এই নির্বাচনে।
আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, দলটি মনে করছে, খুলনার কৌশল ও ফলাফল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কৌশল প্রণয়ন সহজ করে দিয়েছে। খুলনায় বিএনপির প্রচুরসংখ্যক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা আছে। তাই পুলিশ দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িছাড়া করা গেছে। তাই মারামারি না করেও ভোটের মাঠ একচেটিয়া দখলে ছিল আওয়ামী লীগের। খুলনা নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনকেও চাপে রাখার কৌশল নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তা-ও কাজে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, খুলনায় বিএনপি নির্বাচন বর্জন না করায় গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, খুলনার ভোটাররা অত্যন্ত পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ কী করছে, ভবিষ্যতে কী করতে পারে-এটা বিবেচনায় নিয়ে তালুকদার আবদুল খালেককে বিজয়ী করেছেন। তিনি মনে করেন, খুলনাকে ভিত্তি ধরলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এমন ফল হতে পারে। বিএনপি ৯০ থেকে ১০০টা আসন পেতে পারে।
অন্যদিকে বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, আগামী দিনের নির্বাচনগুলো কেমন হবে, তার একটা ধারণা তারা খুলনায় পেয়েছে। সরকার প্রশাসনকে ব্যবহার করে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর নতুন ব্যবস্থা চালু করেছে। নির্বাচন কমিশনও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এটা দলের নেতা-কর্মী এবং দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের দেখাতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে ছিল বিএনপি।
বিএনপির ভেতরে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে জোরালো মত আছে। এর বিপক্ষেও মত আছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে খুলনায় শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকার সিদ্ধান্ত ছিল। ভবিষ্যতে আরও যেসব সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে, সেগুলোতেও বিএনপি একইভাবে থাকার চিন্তা করছে। এর মাধ্যমে দলে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী নেতাদের বোঝানো যে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে ফল এমনই হবে।
বিএনপির সূত্র জানায়, সরকারের নয়া কৌশলের পাল্টা কী করা যায়, তা নিয়ে ইতিমধ্যে দলে অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কী আছে, সেটাও খুঁজছেন দলের কেউ কেউ। একটি অংশ মনে করছে, সরকার যেকোনো মূল্যে জিতবে-এই ধারণার কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকের মধ্যে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে দ্বিধা আছে। তবে সরকারের কঠোর অবস্থানের বিপরীতে মাঠে থাকা কতটুকু সম্ভব বা এখনই সাংঘর্ষিক অবস্থায় যাওয়া ঠিক হবে কি না, এসব নিয়েও বিচার-বিশ্লেষণ করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সমন্বয়ক খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বলছে, তাদের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। কিন্তু তা যে হয় না, এর নমুনা খুলনায় দেখা গেছে। গাজীপুর নিয়ে তাঁরা দলীয়ভাবে চিন্তাভাবনা করছেন।
নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ইসির কিছু পদক্ষেপ ও নির্লিপ্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনের আগে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল ইসি। সেখানকার রিটার্নিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করায় সেখানে একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান সমন্বয়ক করে পাঠানো হয়। বিপরীতে বিএনপির অভিযোগ ছিল খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে। বিএনপি তাঁর প্রত্যাহার চেয়েছিল। তবে ইসি তা আমলে নেয়নি। তফসিল ঘোষণার পরও বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, ঘরে ঘরে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ, এ ব্যাপারে ইসিতে বারবার অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি বিএনপির মেয়র প্রার্থী। সামনে আরও চারটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানেও একই অবস্থা থাকলে জাতীয় নির্বাচনের আগে ইসির গ্রহণযোগ্যতা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, খুলনায় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কতগুলো প্রশ্ন উঠেছে। ইসিকে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে তারা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ইসি হলফনামা যাচাই করেনি, বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।