নিজস্ব প্রতিবেদক
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার প্রথম সোপান। সে পথ ধরেই সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। ইতিহাসের সোনালী এ অধ্যায় রচিত হয়েছে যাদের হাত দিয়ে তাঁরা অমর ও চির স্মরণীয়। তারই ধারাবাহিকতায় গজারিয়া উপজেলায়ও পড়েছিল এর প্রভাব। জানা যায়, ভাষা আন্দোলনে গজারিয়ায় প্রথম ভূমিকা নেন ভবেরচর ওয়াজীর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্ররা।
তৎকালীন ঢাকার সাথে গজারিয়ার যোগাযোগের একমাত্র বাহন ছিল নৌযান। স্বাভাবিক কারণেই বায়ান্ন সালে এখানকার সাধারণ মানুষের সংবাদপত্রের ভাবনা ছিল আকাশ কুসুম। দ্বীপ সদৃশ এই এলাকায় দেশের কোন খবরই এসে পৌঁছাতো না। তবে গজারিয়ায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা জানতে পারে পরের দিন সকালবেলা চর বাউশিয়া গ্রামের মমতাজ উদ্দিন আহমেদের বড় ছেলে তৎকালীন সময়ের ঢাকা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র হেলাল উদ্দিন আহমেদের মাধ্যমে। যতদূর জানা গেছে, ষ্টিমারে করে ২২ ফেব্রুয়ারী ওয়াজীর হাই স্কুলে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকা নিয়ে হাজির হন হেলাল উদ্দিন। এদিকে আজাদের খবর দেখে ছাত্ররা ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত ও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। তাৎক্ষণিক ক্লাস বন্ধ করে জামতলায় অবস্থান করে। ছাত্রদের সাথে মিটিংয়ে বসলেন তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম মিয়াও। সেই মিটিংয়ে হরগঙ্গা কলেজ বিএ এর শেষ বর্ষের ছাত্র মোয়াজ্জেম হুমায়ুন খাঁনকে আহ্বায়ক ও এসএসসি পরীক্ষার্থী সালাহউদ্দিন খাঁন বকুলকে সদস্য সচিব করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ২৩ ফ্রেব্রয়ারী সকালে ওয়াজীর হাই স্কুলের ৩০ জন ছাত্র ঐতিহাসিক জামতলা থেকে হাড়িখালি হয়ে রসুলপুর নদী পার হয়ে বাঁশগাঁও হালট ধরে মেঘনা নদীর পাড়ে গজারিয়া ফাঁড়ি ঘেরাও করবে। অতঃপর সেদিন ফাঁড়ির সামনে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই, বিভিন্ন শিরোনামে শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে ছাত্ররা। সেসময় মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন ভিটিকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান, গুয়াগাছিয়ার আবদুল লতিফ ফারুকী, পুরান বাউশিয়ার রেজা জাহাঙ্গীর, এএফএম আরশাদ আলী, আবদুল কাদির ভাষানী, আব্দুর রশিদ, ইমামপুরের আবদুল গফুর খাঁন, রসুলপুরের সালেহ আহমেদ চৌধুরী রেনু মিয়া, কালীপুরার সানাহউল্লাহ চৌধুরী, আরসুরুদ্দিন, জষ্টিতলার আউয়াল খান, বাঘাকান্দির আবদুল লতিফ, ষোলআনীর হাফিজ উল্লাহ, কামাল উদ্দিন, লক্ষীপুরের আব্দুর রব সরকার, আসলাম মিয়া, মোঃ হানিফ প্রধান, বোরহান উদ্দিন ফরাজি প্রমুখ। (সূত্র : একটি বিদ্যালয় বৃত্তান্ত। লেখক : সাহাদাত পারভেজ)
সময়ের কালে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও যায়নি অমর ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। তৎকালীন দু’একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও অবকাঠামোগতভাবে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয় ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের সময় গজারিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের একদল ছাত্রের হাতে। যাদের নেতৃত্বে সেই শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম আব্দুল খালেক আলো (গোসাইচর), মুহাম্মদ আবুল কাশেম (গজারিয়া), ফজলুল হক (গজারিয়া), আবু তালেব ভূঁইয়া (সোনাইকান্দী), আমিরুল ইসলাম (গজারিয়া), আক্তার হোসেন মোল্লা (সোনাইকান্দী), শফিউল্লাহ (সোনাইকান্দী), মোয়াজ্জেম (গোসাইচর), আহসান উল্লাহ (গজারিয়া), শাহজাহান (গোসাইচর) প্রমুখ।
পরবর্তী ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সেই শহীদ মিনারটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পুনরায় সেই শহীদ মিনারটি নির্মাণে যে ক’জন নেতৃত্ব দেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম আমিরুল ইসলাম। তিনি সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে প্রথম ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে ক্ষতিগ্রস্ত শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য আমরা স্কুলের ছাত্ররা দল বেঁধে তৎকালীন সিও (সার্কেল অফিসার) উন্নয়ন এর কাছে যাই সিমেন্টের জন্য। কিন্তু সিও সাহেব আমাদের সিমেন্ট দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেয়। উপায় না দেখে স্কুলের প্রধান শিক্ষক এর পরামর্শে তৎকালীন সংসদ সদস্য কে এম শামছুল হুদার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়। হুদা স্যার সেদিন শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ৩ ব্যাগ সিমেন্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়। সেই নির্দেশের ৩ ব্যাগ এর বামপাশে ১ যোগ করে ১৩ ব্যাগ বানিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা ছাত্ররা সেই সিমেন্টের ব্যাগ মাথায় করে নিয়ে এসেছিলাম। কিছু ব্যাগ বিক্রয় করে অন্যান্য খরচ নির্বাহ করেছিলাম। যে শহীদ মিনারটি আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে গজারিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের কোণে। দীর্ঘদিন এই শহীদ মিনারটি ছিল ভাষা শহীদদের প্রতি উপজেলাবাসীর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য একমাত্র মিনার। সময়ের পরিক্রমায় আজ উপজেলা প্রাঙ্গণেও নির্মিত হয়েছে সুবিশাল ও দৃষ্টিনন্দন একটি শহীদ মিনার। এছাড়াও প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে প্রাণের এই মিনার।