নিজস্ব প্রতিবেদক
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্পসহ সব খাতে গ্যাসের দাম সমন্বয় করে নতুন দাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের বিরোধিতার মুখেই আজ রবিবার বেলা ৩টায় আনুষ্ঠানিকভাবে দাম ঘোষণা করা হবে। বিইআরসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গ্যাসের দাম গড়ে প্রায় ১৮ শতাংশের মতো দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আবাসিকে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারীদের দাম ৪৫ শতাংশের মতো বাড়তে পারে। নন মিটার গ্রাহকদের ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৮০ টাকার মতো হতে পারে। এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামের বিষয়টি এখন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হাতে। তবে প্রধানমন্ত্রী এমন কোনো কিছু করবেন না যাতে মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
পেট্রোবাংলা বলেছে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। যে কারণে স্পর্ট মার্কেট থেকে চড়া দরে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এজন্য ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। তবে বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির পক্ষে মতামত দেয় গণশুনানিতে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেছেন, বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রত্যেকটিই মুনাফায় রয়েছে। বর্তমান অবস্থায় জনগণের বাড়তি দাম দেওয়ার সামর্থ নেই। আর কোম্পানিগুলো দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছি গ্যাসের দাম ১৬ পয়সা কমানো যায়। করোনার কারণে সংকটকালীন সময় পার করছি, এমন সময়ে ভর্তুকি বাড়ানোর কথা, সেখানে আগের নির্ধারিত ভর্তুকির অর্থই দেওয়া হয়নি। প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার কথা, এখন পর্যন্ত দিয়েছে মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা। সরকার আর ভর্তুকি দেবে না এমন কথা বলেনি। তারপরও বিইআরসি কারিগরি কমিটি অন্যায়ভাবে সেটাকেই (৩ হাজার কোটি) ভিত্তি ধরে ক্যালকুলেট করে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি সুপারিশ করেছে।
তিনি বলেন, সরকার ভাট-ট্যাক্সসহ নানাভাবে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কোন কোম্পানি কত ডিভিডেন্ট দেবে সেই সিদ্ধান্তও চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা মুনাফা তুলে দিচ্ছে আর কোম্পানিগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে গ্রাহকের কাছে টাকা চাইছে। মালিক হিসেবে সরকারের দায়িত্ব প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন করা। কোম্পানিগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিতরণ মার্জিন বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সর্বশেষ ২০১৯ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে পাইকারি দর প্রতি ঘনমিটার ১২.৬০ টাকা করা হয়। ভর্তুকি দিয়ে ৯.৭০ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দেয় বিইআরসি। মার্চে টানা চার দিনব্যাপী গ্যাসের দামবৃদ্ধির উপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর গণশুনানিতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১২ টাকা ৪৭ পয়সা নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করে বিইআরসির কারিগরি (মূল্যায়ন) কমিটি। এখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাস বিক্রি হচ্ছে ৯ টাকা ৩৬ পয়সায়। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটারে ৩ টাকা ১১ পয়সা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে গ্যাসের দাম প্রায় ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এর আগে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের খুচরা মূল্য ১১৭ শতাংশ বা দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠায় জানুয়ারি মাসে। তাতে রান্নার জন্য দুই চুলার সংযোগে ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা এবং এক চুলার ব্যয় ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এছাড়া আবাসিকে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের বিদ্যমান মূল্য ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭.৩৭ টাকা, সিএনজি প্রতি ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬.০৪ টাকা, হোটেল-রেস্টুরন্টে ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯.৯৭ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭.০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৭.০২ টাকা, ১০.৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৩.৮৫ টাকা থেকে ৩০.০৯ টাকা, চা শিল্পে ১০.৭০ টাকা বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা করার প্রস্তাব করে। অন্যদিকে, বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় থাকা বিদ্যমান দর ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯.৬৬ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। বাড়তি বিদ্যমান গড় ৯.৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০.৩৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়।
কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিতরণ মার্জিন বৃদ্ধির আবেদন করে। গণশুনানিতে বিইআরসি কারিগরি কমিটির মতামতে বলেছে ইউনিট (ঘনমিটার) প্রতি বিদ্যমান ২৫ পয়সা চার্জ কোনো কোম্পানির প্রয়োজনীয়তা নেই। ৬ বিতরণ কোম্পানির মধ্যে কর্ণফুলীর কমানো আর অন্যদের বিতরণ মার্জিন বাতিলের সুপারিশ করে।
বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল গণশুনানি বলেছিলেন, গ্যাস খাতের সব সংস্থার কাছে ১২ হাজার কোটি টাকা জমা আছে। সাধারণত মানুষ দুর্যোগে পড়লে শেষ সঞ্চয় ব্যবহার করে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। আবার বিতরণ কোম্পানির মালিক সরকার, তারা কেনো প্রস্তাব এনেছে সরকারের সিদ্ধান্ত কিনা, তাদের সঙ্গে কথা বলে যৌক্তিকতা নিশ্চিত করেই কমিশন আদেশ দেবে।