বিশেষ প্রতিবেদক
দেশে বছর বছর বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তাতে বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যাও। দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশগুলো বজ্রপাতের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে, তার একটি বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এদেশের আকাশে ঠান্ডা ও গরম বাতাসের সংমিশ্রণ ঘটছে। আর তাতে সৃষ্টি হচ্ছে প্রাণঘাতী বজ্রপাত। দেশের হাওরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গাছপালা না থাকায় সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। সাধারণত এপ্রিল, মে ও জুন মাসকে বজ্রপাতের মৌসুম বিবেচনা করা হয়। গত দুই-তিন বছরে বজ্রপাতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে প্রাণহানির সংখ্যা। বরাবরের মতো এবারও এপ্রিলের শুরু থেকেই তাপমাত্রায় ঊর্ধ্বগতি। ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ দূষণের কারণে বজ্রপাতের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদফতর এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত গত ৯ বছরে বজ্রপাতে এদেশে এক হাজার ৯৫৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। তার মধ্যে গত ৩ বছরে ৮৭৮ জন মারা যায়। শুধুমাত্র গত বছরই বজ্রপাতে মারা যায় ১৯৮ জন। এবার কক্সবাজারের মহেশখালীতে মৌসুমের প্রথম বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বজ্রপাতে প্রাণ হারায় ওই এলাকার ৩ লবণচাষি। পরের দিন ফুটবল খেলতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যায় কুমিল্লার এক তরুণ। একই দিন পটুয়াখালীর ৩ উপজেলায় পৃথক ঘটনায় প্রাণ হারায় ৪ জন।
সূত্র জানায়, বজ্রপাতের বড় কারণ তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি। বায়ুমন্ডলীয় ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে ভূপৃষ্ঠ থেকে যাওয়া গরম বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের মেঘ তৈরি করে। তাছাড়া পরিবেশ দূষণও অন্যতম কারণ। বিশেষ করে স্বাস্থ্যগত অন্যান্য ঝুঁকির পাশাপাশি বজ্রপাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে চলেছে দেশের ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ। এই ঝুঁকি নিরসনের জন্য প্রথমেই ভূপৃষ্ঠের বাতাস ঠান্ডা রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। আর ব্যাপক বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়েই তাপমাত্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব। তবে দেশের বরিশাল ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় তাপমাত্রা সব সময় তুলনামূলক বেশি থাকে। ফলে ওসব এলাকায় বজ্রপাতের সংখ্যাও বেশি। তবে বৃক্ষ আচ্ছাদিত হওয়ায় ওসব এলাকায় মৃত্যুর হার কম থাকে। সেদিক থেকে হাওরাঞ্চলে বজ্রপাত সংখ্যায় কম হলেও প্রভাব বেশি। মৃত্যুর হারেও হাওর এগিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে আকাশের চোখ রাঙানি। চৈত্রের শেষে আর কটা দিন পর কান পাতলেই শোনা যাবে আকাশ বিদীর্ণ শব্দ। তবে করোনার এই লকডাউনের মধ্যে বজ্রপাত অতীতের তুলনায় কম মৃত্যু নিয়ে আসতে পারে। কারণ লকডাউনের কারণে শহর থেকে গ্রাম- সর্বত্রই নানা পেশার মানুষ এখন ঘরবন্দি। খুব কম সংখ্যক মানুষ মাঠেঘাটে অবস্থান করছে। ফলে চলতি মৌসুমে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কিছুটা হলেও কমতে পারে। তবে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে মানুষের অসচেতনতা। বিশেষ করে চর ও হাওর এলাকায় জীবিকার তাগিদে কেউ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে বজ্রপাতের কবলে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে ২ দিনে ৩ জেলায় ছাত্র, কৃষকসহ ৮ জনের মৃত্যুর ঘটনা ওই সতর্কবার্তাই দিচ্ছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বজ্রপাত প্রতিরোধের বৈজ্ঞানিক উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অন্তত এক ঘণ্টা আগে পূর্বাভাস জানা সম্ভব। বিশেষ করে হুইসেল পদ্ধতিতে বজ্রপাত নিরোধে সফলতা পাচ্ছে জাপান। বাংলাদেশেও তা অনুকরণ করা যেতে পারে। এদেশে কৃষকরা সাধারণত দীর্ঘ সময় মাঠে অবস্থান করেন। সেজন্য তাদের ঝুঁকির আশঙ্কাও বেশি। তাদের জন্য কিছু নিরাপদ অঞ্চল ঘোষণা করা যেতে পারে। বিশেষ করে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা আগে পূর্বাভাস পেয়ে হুইসেল বাজানো হলে তারা নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় নিতে পারবেন। বজ্রপাতের মৌসুম ইতোমধ্যে হাজির। সেজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ড. মো. আবদুল মান্নান জানান, প্রতি বছর দেশে বজ্রপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত পাঁচ দশকে দেশের তাপমাত্রা পৌনে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়তি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বিপরীতে বজ্রপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায় ১২ শতাংশ। আর খোলা স্থানে বজ্রপাত হলে প্রাণহানির ঝুঁকি বেশি হয়।