নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বেজগাঁও ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের গৃহবধূ আঁখিনূরকে গতমাসে তার স্বামী ও তার বন্ধু মিলে হত্যা করে। তাদের মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড ভিত্তি করে গ্রেফতারের পর নৌপুলিশের কাছে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে তারা।
চাঁদপুর অঞ্চলের নৌপুলিশের সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রেস ব্রিফিংয়ে আসামীদের জবানবন্দি স্বীকারোক্তিতে জানান, আঁখিনূর হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর শেখের সাথে আঁখিনূর আক্তারের ২০০৪ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পর ৬-৭ বছর একসাথে তারা নারায়ণগঞ্জে বসবাস করত। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীর তার স্ত্রী নিয়ে নিজ বাড়ি লৌহজংয়ের বেজগাঁওয়ে চলে আসে। দীর্ঘ ১৮ বছরের সংসার জীবনে তাদের কোন সন্তান ছিল না। একটি মেয়েকে নিয়ে এসে লালনপালন করে। বর্তমানে তার বয়স চৌদ্দ বছর। তার নাম জেরিন। সে নবম শ্রেণিতে পড়ে। এলাকায় আসার পর প্রায় আঁখিনূর তার বাপের বাড়িতে পার্শ্ববর্তী টুলুগাঁও চলে যেত। এই নিয়ে মাঝে মাঝে আঁখিনূরের স্বামী জাহাঙ্গীরের সাথে ঝগড়া-বিবাদ হতে। স্বামী জাহাঙ্গীরকে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তার স্ত্রী তাকে দুইবার (৮০ হাজার ও ৭০ হাজার টাকা) লোন উঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীর ওই টাকা পরিশোধ করে। দুইমাস আগে ব্যবসায় লস যাওয়ার দরুন জাহাঙ্গীর তার বউকে এক লক্ষ টাকা কিস্তি উঠিয়ে দেওয়ার জন্য বলে। কিন্তু তার স্ত্রী কোনভাবে জাহাঙ্গীরকে লোন তুলে দিতে রাজি হয়নি। এতে জাহাঙ্গীরের প্রচুর ক্ষোভ তার স্ত্রীর প্রতি। উক্ত ক্ষোভের বিষয়ে জাহাঙ্গীর তার বন্ধু বেজগাঁও বাজারে সিঙ্গারা-পুরির দোকানদার শাহ আলম বেপারীকে জানায়।
শাহ আলম বেপারী বউকে মেরে ফেলার পরামর্শ দেয়। দু’জনে এই ঘটনা ঘটানোর জন্য বিগত একমাস যাবত পরিকল্পনা করে আসছিল আঁখিনূরকে কিভাবে হত্যা করা যায়।
তখন শাহ আলম বেপারী বন্ধু জাহাঙ্গীরকে বলে হত্যা করতে হলে তো লাখ টাকা লাগবে জাহাঙ্গীর বলে আমার কাছে এত টাকা নাই। আমি তোকে পাঁচ ছয় হাজার টাকা দিতে পারব। তখন জাহাঙ্গীর শাহ আলমকে বলে কিস্তির টাকা কথা বললে আঁখিনূর যেতে রাজি হবে। ঘটনার এক সপ্তাহ আগে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে দিনের বেলা ১১টায় কথা হয় তিনজনের। একসাথে বসে শাহ আলম বলে, ভাবি আমার জমির দলিল জাজিরা ব্যাংকে দেওয়া আছে। একদিন আপনার যেতে হবে জাহাঙ্গীরকে এক লক্ষ টাকা লোন তুলে দিবো। শাহ আলমের কথায় আঁখিনূর রাজি হয়। গত ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে জাহাঙ্গীর শাহ আলমকে বলে আমি ট্রলার ভাড়া করেছি দুই হাজার দিয়ে পেল কিনে রাখছি, সমস্যা হবে না। রাত ৯টা পনেরো মিনিটের দিকে জাহাঙ্গীর বলে শাহ আলমকে, আঁখিনূরকে বলে দাও। আঁখিনূরকে কল দিয়ে শাহআলম বলে ভাবি কয়দিন আগে লোনের কথা বলছিলাম কালকে যাওয়া লাগবে তখন আঁখিনূর বলে ঠিক আছে কাল যাব কল দিয়েন।
ঘটনার দিন ১ নভেম্বর সকালে তখন দুইজনে পরামর্শ করে স্কচটেপ কিনে জাহাঙ্গীর লৌহজং পুরাতন থানার ঘাটে অটোরিক্সা দিয়ে চলে যায়। আর শাহ আলম গাঁওদিয়া ট্রলার ঘাট হতে টলার নিয়ে লৌহজং পুরাতন থানা মাঠে আনুমানিক ১২টার দিকে আঁখিনূরকে কল দেয়। তারপর তারা তিনজন ট্রলারে ওঠে জাজিরা শরীয়তপুরের দিকে রওনা করে। প্রায় আনুমানিক দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে বালুরটেকের সামনে পদ্মা নদীর মাঝখানে ট্রলার চালু অবস্থায় আঁখিনূরকে শাহ আলম প্রথমে পিছন থেকে এসে ঘাড়ে ধরে ট্রলারের মাঝখানে ফেলে বুকের উপর বসে দুই হাত দিয়ে গলায় চাপ দিয়ে ধরে বসে থাকে। পরে জাহাঙ্গীর দুই হাত ধরে বেঁধে ফেলে পরবর্তীতে পাঁচ ছয় মিনিট পর চারপাশে কোন লোকজন ও জেলের নৌকা না থাকায় পদ্মা নদীর মাঝখানে ফেলে দেয়। পরবর্তীতে তারা দু’জন ট্রলারযোগে লৌহজংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা করে জাহাঙ্গীরকে এমপি এমিলির বাড়ির ঘাটে নামিয়ে দিয়ে শাহআলম ট্রলার নিয়ে গাঁওদিয়া ঘাটে ট্রলার রেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়।
গত ৩ নভেম্বর সকাল ৮টায় চন্ডিপুর লঞ্চঘাটের পূর্বপাশে পদ্মা নদীতে একটি অজ্ঞাত মহিলার মৃতদেহ ভাসমান অবস্থায় দেখে এলাকার লোকজন তাৎক্ষণিক সুরেশ্বর নৌ পুলিশ ফাঁড়িকে জানালে সুরেশ্বর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মোঃ নাজমুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এলাকার লোকজনের সহায়তায় মৃতদেহটি উদ্ধার করে দেখা যায় যে, মৃত মহিলার হাত-পা বাঁধা এবং নাক মুখ সাদা স্কচটেপ দিয়ে প্যাঁচানো। পরবর্তীতে লাশটি শনাক্ত করার জন্য সিআইডি ক্রাইম সিন ফরিদপুরকে অবগত করিলে তারা তথ্য প্রযুক্তি ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে মৃতদেহের নাম আঁখিনুর আক্তার, পিতা আফজাল শেখ, সাং জোরপুল ঢলুগাঁও, মুন্সীগঞ্জ সনাক্ত করেন। লৌহজং থানা পুলিশকে অবগত করে জানায় যে, আঁখিনূর আক্তার নামে একজন মহিলার নিখোঁজ ডায়েরি হয়েছে। পরবর্তীতে থানা পুলিশ আঁখিনূর আক্তারের আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিয়ে মৃত আঁখিনুর আক্তারকে স্বামী মোঃ জাহাঙ্গীর শেখসহ আত্মীয়-স্বজন শরীয়তপুর সদর মর্গে এসে মৃতদেহের পরনে থাকা কালো বোরকা, জামা, পায়ের নুপুর ও কানের ফুল দেখে আঁখিনূরকে সনাক্ত করে নিয়ে এসে মৃতদেহ দাফন করে।
লৌহজংয়ে আঁখিনূর হত্যায় জড়িত স্বামী ও তার বন্ধু গ্রেফতার
আগের পোস্ট