তথ্য ও প্রযুক্তি ডেস্ক
ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২২-এর সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় সরকার এখন ২০৪১ সালের মধ্যে উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অত্যাধুনিক পাওয়ার গ্রিড, গ্রিন ইকোনমি, দক্ষতা উন্নয়ন, ফ্রিল্যান্সিং পেশাকে স্বীকৃতি প্রদান ও নগর উন্নয়নে কাজ করছে।
দেশের জন্য নতুন ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব প্রদানে সুযোগ অন্বেষণে রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারের বিসিসি অডিটোরিয়ামে সোমবার ‘ভিশন ২০৪১: বিল্ডিং স্মার্ট সিটি অ্যান্ড স্মার্ট ভিলেজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে।
কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
এতে সভাপতিত্ব করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। কর্মশালাটিতে মডারেটর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন এটুআই-এর প্রকল্প পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবির।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান এবং সংশ্লিষ্ট খাতের অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা। কর্মশালার শুরুতে স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ নির্মাণে নকিয়া বেল ল্যাবস-এর উদ্ভাবিত বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং বাংলাদেশে স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বাস্তবায়নের সুযোগ ও সম্ভাবনা নিয়ে আলাদা দুটি উপস্থাপনা প্রদান করেন বাংলাদেশে নকিয়ার কান্ট্রি হেড মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম এবং এটুআই এর পলিসি অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরী।
মো. তাজুল ইসলাম বলেন, শহরে থাকা মানুষের জন্য স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে আমাদের অনেকগুলো ইস্যু নিয়ে কাজ করতে হবে। আইসিটি বিভাগ জনবান্ধব সেবা প্রদানে এরইমধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছে। স্থানীয় সরকার ও আইসিটি বিভাগ সাধারণ মানুষের আশা পূরণে সামনের দিনে সম্মিলিতভাবে জনকল্যাণমূলক কাজ করতে পারে। স্মার্ট সিটি বাস্তবায়নে নির্ধারিত এলাকায় থাকা জনসংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে ওই এলাকার জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে মাইন্ডসেট পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে জন্য শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আমাদের কার কোন জায়গায় কাজ করার সুযোগ আছে তার একটি সুনির্দিষ্ট ক্যানভাস তৈরি করতে হবে ও প্রত্যেকের কাজগুলোর মধ্যে সমন্বয় রাখতে হবে। আমরা বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তিবান্ধব, প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দক্ষ মানুষ তৈরি করতে চাই। যাদেরকে মানবিক ও সৃজনশীল হতে হবে।
হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও হিউম্যানওয়ারকে একসঙ্গে কাজে লাগানোর উপর গুরুত্বারোপ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, এই তিনটি একসঙ্গে মিললেই বিজয়ী হওয়া সম্ভব। এর মধ্যে হিউম্যানওয়ার তথা মানুষকেই আসল ভূমিকা পালন করতে হবে। আর না হয় সব প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও তার যথোপযুক্ত ব্যবহার সম্ভব হবে না। আর একজন সত্যিকারের মানুষ তৈরির জন্য তাদের কেবল প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুললেই হবে না তাদের মানবিক মানুষ হিসেবেও তৈরি করতে হবে।
ডিজিটাল কানেক্টিভিটির উপর গুরুত্বারোপ করে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি হবে পরবর্তী উন্নয়নের মহাসড়ক। এই মহাসড়ক ছাড়া স্মার্ট সিটি বা স্মার্ট টেকনোলজি কোনোটাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক এগিয়ে রয়েছে। ২০২১ সালেই আমরা পরীক্ষামূলকভাবে দেশে ফাইভজি (৫এ) সেবা চালু করেছি এবং এরইমধ্যে ফাইভজি (৫এ) কানেক্টিভিটি সেবা নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে। স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বিনির্মাণে স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নয়নে আমাদেরকে ফাইভজি কানেক্টিভিটির সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে।
স্মার্ট সিটি বিনির্মাণে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে উল্লেখ করে মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, স্মার্ট সিটির কনসেপ্ট বাস্তবায়নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এরই মধ্যে কাজ করা শুরু করেছে। এলক্ষ্যে সবার ঢাকা অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নাগরিকদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে করা এক লক্ষ ২৮ হাজার ৭৬৭টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
‘ডিএনসিসিতে ৪৮ হাজার স্মার্ট লাইট স্থাপন করা হয়েছে যা মোবাইল ফোন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এসব লাইটের আলো প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা হচ্ছে। অনলাইনে ট্যাক্স আদায় শুরু করা হয়েছে। ড্রোনের মাধ্যমে এক লক্ষ ২৮ হাজার বাসা-বাড়িকে সার্ভের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বায়োমেট্রিক হাজিরা, অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্স এবং আইওটি’র মাধ্যমে দুই হাজার ৩৫০টি স্থানে ডিজিটাল কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নাগরিক সেবার সব কার্যক্রমকে পর্যায়ক্রমে আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে। এখন ৩৩৩ এর মাধ্যমে নাগরিকরা কোনো অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে এর সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে।’
বুয়েট এর উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করার জন্য বুয়েট-এ এরই মধ্যে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার ফর সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং স্থাপন করা হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের উন্নয়নের জন্য এগ্রিকালচার, পাওয়ার ও অন্যান্য সেক্টরের উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করা হচ্ছে। দেশের প্রেক্ষাপটে স্মার্ট এগ্রিকালচার তৈরিতে বুয়েট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে কাজ করছে। স্মার্ট ভিলেজের অন্যতম উপাদান স্মার্ট এগ্রিকালচার। স্মার্ট এগ্রিকালচারের জন্য আইওটি ডিভাইস ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান বলেন, স্মার্ট এগ্রিকালচারের জন্য ন্যানো টেকনোলজি এবং এআই ব্যবহার করে পরিকল্পনামাফিক কতটুকু সার ও ওষুধ দেওয়া লাগবে তা নির্ধারণ করা সম্ভব। প্রযুক্তি ব্যবহারে আগামী দুই বছরে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হবে। উচ্চফলনশীল ধান চাষাবাদের মাধ্যমে আগামীতে ধানের উৎপাদন বহুগুণে বাড়াবে। ধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে এবং আমদানি না করতে হলে আমাদেরকে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
সভাপতির বক্তব্যে জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক এবং উদ্ভাবনী বাংলাদেশ। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত এই কর্মশালা থেকে পাওয়া সংশ্লিষ্টদের সুচিন্তিত মতামত, উপদেশ ও সুপারিশ ভবিষ্যতে আমাদের পথ দেখাবে। স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট ট্রান্সর্পোটেশন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স, রোবটিক্স, মাইক্রোচিপ ডিজাইনিং অ্যান্ড ম্যানুফেকচারিং ও সাইবার সিকিউরিটি এই চারটি প্রযুক্তিতে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।
কর্মশালায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা, চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি, আইসিটি খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতা, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনের নেতা, টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা উপস্থিত ছিলেন।