২০২১ সালের ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল থেকে এমভি সাবিত আল হাসান নামের লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। কয়লাঘাট এলাকায় আসলে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যায়।
নিজস্ব প্রতিবেদক
এক বছরেও শুরু হয়নি নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যায় ‘এমভি-এসকেএল-৩’ নামে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এমভি সাবিত আল হাসান নামের লঞ্চডুবিতে ৩৪ জন নিহতের মামলার বিচার কাজ। এ ঘটনায় তখন গ্রেপ্তারকৃত ১৪ জন আসামির মধ্যে ১১ জনকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর পিলার স্থাপন করা এবং নৌপথে প্রতিবন্ধকতামূলক নির্মাণ সামগ্রী রেখে নৌপথ সরু করে ফেলাকে দূর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করে ২৩টি সুপারিশ করলেও অদ্যাবধি সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং ১ বছরের ব্যবধানে একই স্পটে আরও একটি মর্মান্তিক লঞ্চ দূর্ঘটনায় ১০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নারায়ণগঞ্জ থেকে সাতটি রুটে চলাচলকারী লোয়ার ডেকের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। জানা গেছে, ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল বিকাল ৫টা ৫৬ মিনিটে ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল থেকে এমভি সাবিত আল হাসান লঞ্চ মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ৬টা ১৫ মিনিটে লঞ্চটি শহরের কয়লাঘাট এলাকায় তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু অতিক্রম করার সময় পেছন থেকে এসকেএল-৩ কার্গো ধাক্কা দিয়ে লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দেয়। এতে লঞ্চের কিছু যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও দুই শিশু, ১৭ নারীসহ ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। দূর্ঘটনার দিন রাতে লঞ্চ ডুবে ৩৪ জন নিহতের ঘটনায় বন্দর থানায় মামলা করা হয়। এছাড়া ঘটনার রাতে জেলা প্রশাসনের সাত সদস্য ও বিআইডব্লিউটিএর পাঁচ সদস্যের দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরেরদিন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে আরও একটি সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ২৬ জন গণশুনানিতে সাক্ষ্যপ্রদান করে। ১০ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া এলাকায় মেঘনা নদী থেকে ‘এমভি-এসকেএল-৩’ নামে কার্গো জাহাজটিসহ এর মাস্টার, ড্রাইভার, সুকানী ও লস্কর ১৪ জনকে আটক করে কোস্টগার্ডের সদস্যরা। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- ‘জাহাজের মাস্টার অহিদুর জামান (৫০), ইঞ্জিন ড্রাইভার মজনু মোল্লা (৩৮), সুকানী আনোয়ার মল্লিক (৪০), গ্রিজার হৃদয় হাওলাদার (২০), গ্রিজার মো. ফারহান মোল্লা (২৭), লস্কর রাজীবুল ইসলাম (২৭), লস্কর মো. আব্দুল্লাহ (২০), লস্কর মো. নূরুল ইসলাম (৩৫), লস্কর মো. সাকিব সরদার (২০), লস্কর মো. আফসার (১৮), লস্কর মো. সাগর হোসেন (১৯), লস্কর আলিফ শেখ (১৯) ও বাবুর্চি আবুল বাশার শেখ (৩৮)। মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ ইউনুস মুন্সী গত বছরের ৯ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। অভিযোগপত্রে ১৪ আসামির মধ্যে ১১ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এসকেএল-৩ কার্গো জাহাজের মাস্টার ওহিদুজ্জামান (৫০), সুকানি আনোয়ার মল্লিক (৪০) ও ইঞ্জিন ড্রাইভার মজনু মোল্লাকে (৩৮) অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এতে বাদী পক্ষের কোনো আপত্তি আছে কি না তা জানতে চেয়েছেন আদালত। গত ২৩ মার্চ অভিযোগপত্র শুনানি শেষে নারায়ণগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শামছুর রহমানের আদালত এ বিষয়ে জানতে পেরে বাদীর প্রতি সমন জারি করেছেন। আগামী ২৬ এপ্রিল বাদীর উপস্থিতিতে এ বিষয়ে ফের শুনানি হবে। এদিকে ওই দূর্ঘটনার পরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ এবং জেলা প্রশাসনের পৃথক ৩টি তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে ২৩টি ও ২১টি সুপারিশ প্রস্তাবনা করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও ১ বছরেও সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কার্গো জাহাজের বেপরোয়া গতি ও নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর ত্রুটিপূর্ণ নকশাকে দায়ী করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। একইসঙ্গে নদীর মাঝখানে নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর পিলার স্থাপন করা এবং নৌপথে প্রতিবন্ধকতামূলক নির্মাণ সামগ্রী রেখে নৌপথ সরু করে ফেলাকে দূর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনেও কার্গো জাহাজের বেপরোয়া গতি, চালকের উদাসীনতা দূর্ঘটনার অন্যতম কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সেই তদন্ত প্রতিবেদনের কোন ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ১ বছরের ব্যবধানে একই এলাকায় আরও একটি মর্মান্তিক লঞ্চ দূর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। গত ১০ মার্চ দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রী নিয়ে এমভি আফসার উদ্দিন নামে যাত্রীবাহী লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ২টা ২০ মিনিটে শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট এলাকায় পৌঁছলে পেছন থেকে সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন এমএল রূপসী ৯ নামে একটি পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ ধাক্কা দিয়ে লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দেয়। এসময় নদীতে লাফিয়ে পড়ে অধিকাংশ যাত্রী তীরে উঠলেও নারী ও শিশুসহ ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। লঞ্চডুবির ঘটনার পরে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল থেকে সাতটি রুটে চলাচলকারী ৭০টি লোয়ার ডেকের লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ রুটে বিআইডব্লিউটিসির সি ট্রাক চলাচল অব্যাহত আছে।