আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ২৮ অক্টোবর
আবু বকর আল-বাগদাদি। ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের জঙ্গি সংগঠনের প্রধান। তার মৃত্যু হয়েছে বলে খবর ছড়িয়েছে। ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তিপূর্ণ মত ছড়িয়েছেন এই বাগদাদি। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন ইরাকের একটি বড় অংশ জুড়ে। পরে আরববিশ্বের আরও কয়েকটি দেশেও ছড়িয়ে পড়ে আইএসের ত্রাসের রাজত্ব। এবার তার মৃত্যুর পর আইএসের ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদগুলোতে আলোচনার শেষ নেই।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, লাদেনের মতো বাগদাদিও যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল আর দুয়েকটি আরব দেশের তৈরি করা। তাকে দিয়ে আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠন গড়ে তুলে গোটা আরবজুড়ে নৈরাজ্য টিকিয়ে রেখেছে দেশগুলো। এর পেছনে তাদের তেলবাণিজ্য থেকে শুরু করে অস্ত্র বিক্রির স্বার্থ জড়িত। অন্যদিকে রয়েছে ইসলামের নামে জঙ্গি কার্যক্রম সংঘটিত করে মুসলিমদের মর্যাদাহানি করে গোটা বিশ্বের কাছে তাদের হেয় করা।
কে এই বাগদাদি?
জানা যায়, বাগদাদি ১৯৭১ সালে ইরাকের দিয়ালা বা সামারায় জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম ইব্রাহিম আওয়াদ আল সামারাই। তিনি দেশটির রাজধানী বাগদাদের ইসলামিক ইউনির্ভাসিটিতে পড়াশোনা করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের সংস্কৃতি ও দর্শন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। বিভিন্ন জিহাদি গ্রন্থে তার পুরো নাম দেওয়া হয়েছে-ইব্রাহিম বিন আওয়াদ বিন ইব্রাহিম আল-বাদরি আল-রাধউই আল-হুসেইনি আল-সামারাই।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করে, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত সামারার মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন বাগদাদি। মার্কিন আগ্রাসন শুরুর পরপরই ইরাকে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেয়। পরের বছরই তিনি জঙ্গিবাদের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। কারাবাসের জীবনই বাগদাদিকে পুরোপুরি বদলে দেয়। ইরাকে আইএসের নেতা হিসেবে উত্থান হয় তার।
২০০৬ সালে মার্কিন বোমা হামলায় আল-কায়েদা নেতা আবু মুসাব আল-জাওয়াহিরির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জঙ্গি সংগঠনটির কর্মকাণ্ড কমে আসতে শুরু করে। নিষ্ঠুর কৌশলের কারণে আল-কায়েদা তার সমর্থন হারাতে থাকে ধারণা করা হয়। ২০১০ সালে সংগঠনটিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আর এ সুযোগটাই কাজে লাগান বাগদাদি।
বাগদাদি ছিলেন ইরাকের সুন্নিদের ওপর পুরোপুরি ক্ষুব্ধ। কিন্তু পরে তিনি ওই সুন্নিদেরই নিজের সমর্থক বানান। মার্কিন আগ্রাসনের কারণে সুন্নিদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে উগ্রবাদ ছড়িয়ে সংগঠনটিকে রূপান্তরের চেষ্টা করেন। তখন তার বয়স ছিল ৩৯ বছর। ইরাকের অস্থিরতা ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বাগদাদির মনোবাসনা পূরণের জন্য উপহার বা আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হয়। একপর্যায়ে বাগদাদি ইরাক ও সিরিয়া জুড়ে দখলকৃত এলাকায় খেলাফত ঘোষণা করেন।
বাগদাদির খেলাফত ঘোষণা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের নিকট বেশ হাস্যকর ঠেকেছিল। কারণ কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীই এভাবে কোন অঞ্চল দখল করে না। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আইএসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর প্রকাশ পায় আইএস জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের মিখার হওয়ার বিদেশি নাগরিকদের ভিডিও। এর পরপরই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন আইএসের বিরুদ্ধে দৃঢ় সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধ শুরু হয়।
যদিও আইএসের মৃত্যুর দাবি এই প্রথম নয়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে ইরাকের মসুলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলায় বাগদাদির নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু পরের বছরই জানুয়ারিতে সিরিয়ার যুদ্ধ পর্যবেক্ষক যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন সিরিয়ান অবজারভেটরি অভ হিউম্যান রাইটস জানায়, ওই হামলা বাগদাদি নিহত হননি। তিনি আহত হয়েছেন।
২০১৭ সালের ১৬ জুন সিরিয়ার রাকায় (আইএসের কথিত রাজধানী) মার্কিন বিমান হামলায় বাগদাদির নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে একটি অডিও প্রকাশের পর চলতি বছর শ্রীলঙ্ক্ষায় বড় দিন উপলক্ষে চার্চে হামলার ঘটনায় আইএস সদস্যদের প্রশংসা করে একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয় বাগদাদির নামে। এরপর থেকে তার বিষয়ে তেমন কোনো খবর আসেনি। সবশেষ গত শনিবার পরিবার নিয়ে তার আত্মঘাতি হওয়ার খবর আসে সংবাদমাধ্যমে।
আইএসের ভবিষ্যত কী?
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাগদাদি নিহত হলেও আইএসের সদস্যরা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই বলা যায়, আইএস এখনও হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। চলতি মাসে আকস্মিকভাবে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে সেখানে আইএস আবারও মাথাচাড়া দেবার সুযোগ পেতে পারে বলে আশঙ্ক্ষা করা হচ্ছে। কারণ সেখানে আইএসের বিরুদ্ধে সাফল্যের মূল কৃতিত্ব ছিল কুর্দিদের। কিন্তু তুরস্কের সামরিক অভিযানের কারণে সেখান থেকে কুর্দি সৈন্যরাও অন্যত্র সরে গেছে। সিরিয়া সীমান্তে কুর্দিদের নিকট বন্দি আইএস জঙ্গিরাও পালাবার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি তুরস্ক প্রায় ২০০ পলাতক বন্দিদের আটক করেছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, বাগদাদিকে ইদলিবে হত্যা করা হয়েছে। কারণ তিনি সেখানে আইএসকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে ইদলিবের জিহাদি দল হুরাস আল-দ্বীন আল-কায়েদার প্রতি আনুগত্যের কারণে হায়াত তাহরির আল-শাম নামে আরেকটি ইসলামি দল থেকে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু হুরাস আল-দ্বীন বা আইএস কেউই ইদলিবে জনপ্রিয় না। এই কারণে তারা সেখানে সহজে ঘাঁটি তৈরি করতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে যদি আইএস বিরোধী আন্তর্জাতিক জোট দেইর আল-যোওর ত্যাগ করলেই, আইএসের পক্ষে ওই এলাকা টার্গেট করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা এসডিএফকে প্রত্যাখ্যানকারী আরব গোত্রসমূহের সহায়তা পাবে। কিন্তু ট্রাম্প জানিয়েছেন, এই জোট সেখানকার তেলক্ষেত্রগুলো শীঘ্র ছাড়ছে না।
কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দাবি, বাগদাদির মৃত্যুকে যদিও একটি প্রতীকী বিজয় হিসেবেও দেখা হয়, তবু সেখানকার স্থানীয় দলগুলোর কোন্দল ও অন্তর্দ্বন্দ্ব আইএসের কাজ করার সুযোগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিবে।
গত জানুয়ারি মাসে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল সিরিয়ার তুলনায় ইরাকে আরও দ্রুত গতিতে আইএসের পুনরুত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে ইরাকে প্রায় দুই হাজার আইএস জঙ্গি সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিরিয়ায় কুর্দিদের সূত্র অনুযায়ী, সে দেশের পূর্বাঞ্চলে আইএস-এর ‘স্লিপার সেল’ গজিয়ে ওঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আইএসের সমর্থক বিভিন্ন মানুষের সেখানে আগমণ ঘটছে।
এমন পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের সিরিয়া নীতি চাপের মুখে পড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমে আইএস এর জমি হারানো এবং এবার বাগদাদির মৃত্যুকে সম্বল করে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে সঠিক হিসেবে তুলে ধরছেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের অধিকাংশ সদস্যসহ এমনকি রিপাব্লিকান দলেও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে। এই অবস্থায় মার্কিন প্রশাসন বাধ্য হয়ে কিছু সৈন্য আইএস দমনে সক্রিয় থাকবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।