নিজস্ব প্রতিবেদক :
দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে গত ২৫ বছর ধরে রূপনগর বারেকের বস্তিতে বসবাস করে আসছিলেন খুশি বেগম। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়েই বিধবা খুশির সংসার। প্রতিদিনের মতো বুধবার সকালে অন্যের বাসায় কাজে গিয়েছিলেন তিনি। আগুনের খবরে যখন ঘরে ফেরেন ততক্ষণে সব শেষ। আগুনে সব পুড়ছিল। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া খুশির কিছুই করার ছিল না।
আগুনের ধ্বংসস্তূপ থেকে কিছুই মেলেনি তার। বেঁচে থাকার সব স্বপ্ন পুড়ে কয়লা হয়ে ভাসছে ঝিলের পানিতে। সবহারা খুশির আশ্রয় হয়েছে তাই খোলা আকাশের নিচে।
খুশি বলেন, ২৫ বছর আগে নদী ভাঙনের কারণে সব হারিয়ে বাবার হাত ধরে ঢাকার এই রূপনগরের বস্তিতে ঠাঁই হয়েছিল। ২৫ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। মারা গেছে স্বামীও। বেঁচে থাকার কষ্ট-লড়াইয়ের জীবনে এবারের মতো কখনোই সর্বহারা হননি তিনি।
শুধু খুশি বেগম নন এমন হাজারো মানুষ এক আগুনে সব হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। কেউ বা স্কুলের কক্ষে বারান্দ্রায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিলের ওপরে বাঁশের মাচা করে আবার কেউ বা পাকা সিঁড়িতে মাচা করে বানানো ঘরে থাকতেন। বস্তির অধিকাংশ বাসিন্দায় অল্প খরচায় ভাড়া থাকতেন সেখানে। ছিল পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনও। ঘরপ্রতি ২ থেকে ৩ হাজার করে ভাড়া দিতে হতো। একেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ একেক জনের কাছে।
বৃহস্পতিবার (১২ মার্চ) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রূপনগর বারেকের বস্তি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পুরো বস্তি যেন রূপ নিয়েছে ধ্বংসস্তূপে। যতদূর চোখ যায় পোড়া স্তূপ। সেখানেই কেউ কেউ হাত চালিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন শেষ সম্বলটুকু।
দগ্ধ ঘা নিয়ে আসমা আক্তার নামে বস্তির এক বাসিন্দা বলেন, ‘পাঁচ হাজার টাকায় দুই ঘর নিয়ে ভাড়া থাকি। বাসাবাড়িতে কাজ করি। পঙ্গু স্বামী ভ্যানে ফেরি করে পান-সিগারেট বিক্রি করেন। স্বামী আর এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, গত সাত মাস আগে বেঁচে থাকার অনেক আশা নিয়ে ভোলার পশ্চিম ইলিশা এলাকা ছেড়ে বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছিলাম। কিন্তু এখানেই সব হারালাম।
ইয়ানুর বেগম আশ্রয় নিয়েছেন বস্তি সংলগ্ন ইসলামিয়া হাইস্কুলের মাঠে। তিনি বলেন, এখানকার অধিকাংশ মানুষ প্রতিদিন সকালেই বেরিয়ে যান জীবিকার খোঁজে। কেউ বাসা বাড়িতে কাজ করেন কেউবা পোশাক শিল্পে। অধিকাংশ পুরুষরা ভ্যান-রিকশা চালান। কেউবা মিস্ত্রির কাজ ও মুদি দোকান চালান।
ইয়ানুর বেগম বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। কোমরের হাড় ক্ষয়ের কারণে স্বামী কিছু করতে পারে না। তিন ছেলেকে নিয়ে গড়া সংসারে তিনিই কর্মক্ষম। ১৫ বছরের গোছানো ছোট্ট সংসার মিশে গেছে ঝিলের পানিতে।
আবুল কালাম নামে পঞ্চাশোধ্র্ব বৃদ্ধাকে কাঁদতে দেখা যায় ইসলামিয়া প্রাইমারি স্কুলের বারান্দার সিঁড়িতে।
তিনি বলেন, ১৮ বছর ধরে এই বস্তিতে থাকি। ভ্যানের ওপরে পান-সুপারি বিক্রি করি। দুই ছেলে ও চার মেয়েকে সংসার। কাল গেছি মিরপুর-১০-এ পান-সুপারি কিনতে। খবর পাইয়া ছুটে আসি। আইসা দেখি সব জ্বলতাছে। ঘর পোড়ার আগুন নিভছে বাজান কিন্তু অন্তরে আগুন জ্বলতাছে।
স্ত্রীকে নিয়ে বুধবার সকালেই বস্তির ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন মো. মনির (৩০)। স্ত্রী বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ে কাজের জন্য। আর নিজে বস্তির পাশেই রড মিস্ত্রির কাজ করেন।
মনির বলেন, ‘১০টার দিকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পাই। ছাদ থেকে দেখি ধোঁয়া। এরপর দেখি দাউ দাউ করে জ্বলছে বস্তি। আগুন দেখে দৌড় দিই। কিন্তু বস্তিতে ঢুকতে পারি নাই। চাইয়া চাইয়া দেখলাম সব পুড়তাছে। আগুন নিভল কিন্তু নিজের ঘর বলতে কোনো অস্তিত্ব নাই। সব পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে কচুরিপানার সাথে ভাসছিল।’
বুধবার (১১ মার্চ) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর বস্তিতে আগুন লাগে। মুহূর্তের আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়; পুরো বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট পৌনে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় দুপুর ১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
বারেকের বস্তিতে লাগা ভয়াবহ আগুনের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর।
ফায়ার সার্ভিসের ডেপুটি ডিরেক্টর (অ্যাম্বুলেন্স) নূর হাসান হাসানকে প্রধান করে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন-সহকারী পরিচালক নইমুল হাসান, মিরপুর অঞ্চলের উপ-সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন, মিরপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আনোয়ার হোসেন এবং ইন্সপেক্টর গোলাম মোস্তফা।