নিজস্ব প্রতিবেদক
গজারিয়া উপজেলায় কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষকদের জীবনযাপন চরমে পৌঁছেছে। করোনার প্রতিঘাতে দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠানের ভাড়া, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। এসব শিক্ষকদের সহায়তায় কেউ এগিয়ে না আসায় পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে শিক্ষকদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলায় ৫৬টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও ১৪টির অধিক প্রাইভেট হাইস্কুল রয়েছে, যেখানে ৬০০ এর অধিক শিক্ষক নামমাত্র বেতনে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের বেতনের টাকায় পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থীদের বেতন-ভাতা আর টিউশন ফি দিয়ে সংসার চালাতেন তারা। করোনার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের বেতন যেমন বন্ধ, প্রাইভেট টিউশনিও রয়েছে বন্ধ। ফলে একেবারেই বন্ধ শিক্ষকদের আয়। করোনাকালে শিক্ষাঙ্গণের সঙ্কটের চিত্র নিয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে উদ্বেগজনক নানা চিত্র। গজারিয়ায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে ভবন বাড়িওয়ালাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখলেও শিক্ষকরা আশা করছেন যদি পরিস্থিতি ভালো হয় তবে আবার চেষ্টা করবেন খোলার। প্রধান শিক্ষকরা প্রায় প্রত্যেকেই বলছেন, তারা প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিতে চান। কিন্তু এখনতো কেউ তা কিনতেও রাজি হচ্ছেন না। অনেকেই কয়েকমাস ধরে বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছেন। কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষকদের সংগঠন সূত্রে জানা যায়, নিজের প্রিয় প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা ও শিক্ষকরা। জীবন-জীবিকার তাগিদে খুঁজছেন অন্য পেশা। বহু শিক্ষক চাকরি হারিয়ে যুক্ত হচ্ছেন বিভিন্ন পেশায়। গজারিয়ায় আল মদিনা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল জলিল বলেন, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে সব ধরনের আয়-রোজগারও। এক বছরেরও বেশি সময় বন্ধ রয়েছে বেতন-ভাতা। কিন্তু প্রতি মাসে বকেয়ার খাতায় যোগ হচ্ছে স্কুল ভাড়া। সেটার জন্য বাড়িওয়ালা চাপ দিচ্ছেন। চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। একদিকে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে শত শত শিক্ষকরা কর্মহীন হয়ে পড়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অর্থবিত্ত না থাকলেও সমাজে তারা শিক্ষক হিসেবেই সম্মানীয়। ফলে তারা না পারছেন লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে, না পারছেন মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে। ফলে মানুষ গড়ার কারিগররা এখন তাদের সংসারের ব্যয়ভার বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক বলেন, দেশের এমন পরিস্থিতিতে ধার-দেনা করে পরিবারের অন্য সদস্যদের দু’মুঠো আহার যোগাড় করছেন। তবে না পারছেন কারো কাছে হাত পাততে, না পারছেন লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে। অনেক শিক্ষকরা বাচ্চাদের দুধ কিনতে পারছেনা, তারা অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছে। হোসেন্দী রোডে অবস্থিত নিউ সানরাইজ আইডিয়াল স্কুলের অধ্যক্ষ মোঃ কামরুজ্জামান রাসেল বলেন, পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। করোনা মহামারী এক চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকদের কাছ থেকে স্কুলের বেতন আদায় হচ্ছে না। স্কুলের ঘর ভাড়াও পরিশোধ করতে পারছি না। প্রতি মাসেই জমতে জমতে বাড়িভাড়া ও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন মিলিয়ে লাখ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য খরচের বাকির পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। আর কোন উপায় নেই স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠান চালানোর। পরিস্থিতি দীর্ঘ হওয়ায় স্কুল পরিচালনা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের সহায়তা না দেয়া হয় এবং করোনা সঙ্কট আরও বেশি দিন স্থায়ী হয়, তাহলে অনেক কিন্ডারগার্টেন স্কুলই বন্ধ হয়ে যাবে। কঠিন পরিস্থিতিতে পড়া এসব স্কুলের শিক্ষকদের আর্থিক সহায়তা, স্কুল উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত স্কুল খুলে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই। গ্রীন বার্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অধ্যক্ষ মোঃ দুলাল মিয়া বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানের আয়ের সকল উৎস বন্ধ রয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্কুলের ঘর ভাড়া ২ লাখেরও বেশি বকেয়া রয়েছে। এই দুর্যোগকালীন সময়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনও সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের পরিবারে হাহাকার বিরাজ করছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে এসব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক অবদান রয়েছে। করোনার এই দুর্যোগের সময়ে সরকারের উচিত এ সমস্ত শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা করা। করোনা দূর্যোগে আর্থিক সঙ্কটের কারণে কয়েকটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল বিক্রির উদ্যোগও চিরতরে বন্ধের কথা জানিয়ে গজারিয়া উপজেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন এর সভাপতি মোহাম্মদ ফজলুল হক নয়ন বলেন, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষিত বেকার যুবকদের চাকরির পিছনে না ঘুরে চাকরির ক্ষেত্র তৈরীর পরামর্শ দিয়েছেন। সেই পরামর্শকে সামনে রেখেই শিক্ষাদ্যোক্তা হিসেবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্ডারগার্টেন চালু করে গজারিয়ায় প্রায় ৬০০ বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে আজ এই ৬০০ শিক্ষকই বেকার জীবন নিয়ে পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে সমাজে অবহেলার শিকার। এই শিক্ষকরা না পারছে কারো কাছে হাত পাততে, না পারছে কারো কাছে দুঃখ শেয়ার করতে। উপজেলা শিক্ষা অফিসার মহোদয় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের তথ্যও একবার জমা নিয়েছিলেন কিন্তু তারও কোন সুরাহা পাইনি। আজও আশায় বুক বেঁধে আছি কবে সরকারের সুদৃষ্টি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের উপর পড়ে। বর্তমান আর্থিক সঙ্কট ও ভবিষ্যতের আর্থিক দুরবস্থা বিবেচনা করে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।