নিজস্ব প্রতিবেদক
ভালো নেই গজারিয়ায় চাঁই-বুচনার কারিগররা। যে কারণে কমে গেছে চাঁই-বুচনার চাহিদাও। যারা সারা বছর বর্ষা মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে চাঁই-বুচনা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করবে, এ বছর তারা হতাশ। কারিগররা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে বাঁশসহ চাঁই-বুচনা তৈরির উপকরণ কিনেছিলেন। কিন্তু বাজারে চাহিদা না থাকায় তারা বিপদে পড়েছেন। এমনকি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন পাইকার বা মহাজনরা। পাশাপাশি করোনায় এসব নিম্ন আয়ের মানুষগুলো চরম অভাবে দিন কাটাচ্ছে।
বর্ষাকালে দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ বিশেষ করে বাঁশের ফাঁদ (চাঁই-বুচনা) দিয়ে মাছ শিকার করতে দেখা যায়। বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলায় গ্রামগুলোর খাল-বিল নদী-নালায় ফাঁদ পেতে খুব সহজেই বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ শিকার করা হয়। যদিও যুগের সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ফাঁদের আকার, ধরণ ও নকশায় পরিবর্তন হলেও এখনও জনপ্রিয়তা কমেনি চাঁই বুচনা গড়ার। গজারিয়া উপজেলার বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের বড় রায়পাড়া, ভবেরচর ইউনিয়নের ভিটিকান্দি, নয়াকান্দি ও ভবেরচরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, সারা বছর ধরে চাঁই বুচনা তৈরি করে থাকেন স্থানীয় নারী ও পুরুষ কারিগররা। তবে এই ফাঁদ বানানোর ধুম পড়ে যায় বর্ষাকালের আগ মুহূর্তে। আর বর্ষার শুরু থেকে সেসব চাঁই স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রির জন্য উঠানো হয়। স্থানীয়ভাবে এখান থেকে যেমন খুচরা ক্রেতারা চাঁই কিনেন তেমনি আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা চাঁই কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান বিক্রির জন্য। স্থানীয় কারিগর ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন আকার ও আঙ্গিকে তৈরি মাছ ধরার এ ফাঁদগুলোর রয়েছে বাহারি নাম। যেমন- চাঁই-বুচনা, গড়া, চরগড়া, খুচুইন ইত্যাদি। আবার চাঁইয়ের মধ্যেও রয়েছে নামের বিভেদ। যেমন- ঘুনি চাঁই, কইয়া চাঁই, বড় মাছের চাঁই, জিহ্বা চাঁই, গুটি চাঁই ইত্যাদি।
গজারিয়া উপজেলার বড় রায়পাড়া গ্রামের চাঁই ব্যবসায়ী খলিল বলেন, সারাবছর ধরে চাঁই বিক্রি করলেও বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত এই চার মাস বিক্রি বেশি হয়। কাঁচামালের দর বেড়ে যাওয়ায় এখন চাঁইয়ের দরটাও অনেক বেশি। আর ফাঁদ বানানোর স্থানীয় কারিগর সোহেল জানান, মাছ ধরার ফাঁদ তৈরিতে বাঁশ আর সুতা ও প্লাষ্টিক ব্যবহার করা হয়। তবে বাঁশের সংকটের কারণে দিনে দিনে এসব মাছ ধরার ফাঁদের দর বাড়ছে। বর্তমান বাজারে আকার ও আকৃতি ভেদে এসব ফাঁদ ৫০ টাকা থেকে ৪ শত টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে তেতৈতলা গ্রামের সারা বছরই চাঁই দিয়ে মাছ শিকারী আব্দুল মান্নান বলেন, গজারিয়ায় বড় রায়পাড়া গ্রামের মানুষের কাছে চাঁই-বুচনা আগে যেমন জনপ্রিয় ছিল, এখনও রয়েছে। চাঁই খাল আর বিলে কিংবা ডুবে যাওয়া ফসলি ক্ষেতে পেতে রাখা হয়। যেখান থেকে দেশীয় প্রজাতির চিংড়ি, শোল, শিং, কৈ, খইলসা, পুঁটি মাছ ধরা পড়ে। তবে এখন বেশি পানিতেও ফাঁদ পাতার জন্য বড় আকারের চাঁই বানানো হয় যাতে রুই-কাতলও ধরা পড়ে।
নয়াকান্দি গ্রামের ব্যবসায়ী ও কারিগর জাহাঙ্গীর আলম জানান, একটা চাঁই তৈরি করতে বেশি সময় লাগে না। তবে একটা আনতা তৈরী করতে কয়েকদিন লেগে যায়। প্রতি বছর আমাদের তৈরি করা পণ্য প্রত্যেক বাজারে বাজারে ঘুরে বিক্রি করে থাকি। আর বর্ষার মৌসুমে তো চাঁইয়ের কদর বেড়েই যায়। তখন বাড়ি থেকেই চাঁই, আনতা পাইকাররা নিয়ে যায়। আর এ বছর করোনা মহামারীর কারণে আমাদের ব্যবসায় খুবই মন্দা যাচ্ছে। এই বছর আনতা ও চাঁই ভালোভাবে বিক্রি করতে পারছিনা। তিনি আরো জানান, ছোটবেলা থেকে এই আনতা ও চাঁই তৈরি করে বাজারে বাজারে বিক্রি করে থাকি। এই ব্যবসা আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য। আমার বাপ দাদারাও এ ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। বর্তমান ব্যবসার যে পরিস্থিতি তাতে পরিবার নিয়ে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকাই কষ্টকর।
ভবেরচর বাজার দোকানদার ও চাঁই ব্যবসায়ীরা বলেন, লকডাউনে থাকায় আমরা ঠিকমত ব্যবসা করতে পারছিনা। পুলিশ এসে আমাদের দোকান বন্ধ করে দেয়। তারপরও এর ফাঁকে ফাঁকে আমরা চাঁই তৈরি করি। কিন্তু গণপরিবহন চলাচল না করায় আমরা চাঁইগুলো নিয়ে বিপাকে আছি। আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন এলাকার চাঁই ব্যবসায়ীরা আনতা এবং চাঁই ক্রয় করে নেয়। কিন্তু এখন সব বন্ধ থাকায় আমাদের চলাফেরায় অসুবিধা হচ্ছে। এই মুহুর্তে সরকারি কিংবা বেসরকারি সহযোগিতা পেলে আমাদের অনেক উপকার হতো।