নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় শিল্পায়নের ফলে চাষাবাদ কমে গেলেও এখনো প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে মানুষ চাষাবাদের উপরই নির্ভরশীল। এই মুহুর্তে গ্রামগুলোতে ধান তোলার উৎসব বিরাজ করছে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ সোনালী ধানে ভরে গেছে। এ এক অপরূপ দৃশ্য, যেন মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। চারদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ। মনে হয় এমন ধান ক্ষেত দেখেই কবিগুরু উচ্চারণ করেছিলেন- ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়, লুকোচুরি খেলারে ভাই, লুকোচুরি খেলা!’
কবির কবিতার মতোই গ্রাম বাংলার মাঠে-ক্ষেতে এখন ধান কাটার মহোৎসব চলছে। আমার ছোটবেলার চির চেনা কিছু দৃশ্য, যা স্মৃতিপটে অমলিন, ধানের মাঠ, ধান কেটে মাথায় করে সে ধান বাড়িতে নিয়ে আসা, বাড়ির উঠানে কিংবা জমিতে খোলা করে সে ধান মাড়াই, ঝাড়াই, কুলাতে ধান নিয়ে বাতাসের মধ্যে উড়িয়ে ধান বাছাই করা, বড় বড় ড্রামে সে ধান সেদ্ধ করা, রোদে শুকাতে দেওয়া, ধানের খড় এখানে সেখানে শুকাতে দেওয়া, মেঘলা আকাশে তড়িঘড়ি করে গুছানো এসব আজ স্মৃতিপটে অমলিন।
এই মুহূর্তে নব উদ্দীপনায় আন্দোলিত হয়ে ওঠেছে কৃষাণ-কৃষাণীর জীবন। কড়া রোদে পুরোদমে মাড়াইয়ের পাশাপাশি শুকানো ও সেদ্ধ করার কর্মযজ্ঞের উচ্ছ্বাস চলছে ঘরে ঘরে। এই ইরি ধানেই কৃষকের চোখেমুখে অভাব ঘুচানোর স্বপ্ন। সোনালী ধান ক্ষেতে কাটার আগেও এই ধানগাছগুলোই দাঁড়িয়েছিলো মাথা উঁচু করে। দলবেঁধে মাঠে ফসল কাটার পর শ্রমিকেরা আঁটি বেঁধে মাথায় করে গৃহস্থের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতের পাশে কিংবা বাড়ির উঠোনে পূর্ণদ্যমে হাতেই চলছে মাড়াইয়ের কাজ। অনেক কৃষক ধান মাড়াইয়ে মেশিনের সাহায্যও নিচ্ছেন। মাড়াইয়ের পর রোদে শুকানোর কাজে কৃষাণীকে সহায়তা করছেন কৃষক। দিন-রাত পরিশ্রম করছেন তারা। ভালো ফলনের পর নতুন ধানের মন মাতানো সৌরভে চাঙ্গা তাদের জীবন। বসে থাকার সময় নেই গ্রামীণ বধূরও। অনাবিল হাসি নিয়ে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুলোয় করে ধানের ‘চুছা’ ছাড়ানোর কাজ করছেন। ধান শুকানো থেকে শুরু করে সেদ্ধ করার কাজ মূলত কৃষাণীরাই করেন। এরাই আবার প্রখর রোদে পায়ের পাতা ধানে ডুবিয়ে রোদে নাড়েন। সব মিলিয়ে একটা শৈল্পিক চিত্র।
গত ক’দিন আগে উপজেলার ভবেরচর ইউনিয়নের বাগানবাড়ি এলাকায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) স্নেহাশীষ দাস প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে ধান কাটার উদ্বোধন করেন। ইতিমধ্যে উপজেলার কৃষকরা যেন বোরো ধান নিরাপদে-নির্বিঘ্নে ঘরে তুলতে পারেন সেলক্ষ্যে নানা ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছেন প্রশাসন।
গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জিয়াউল ইসলাম চৌধুরী বোরো ধান কর্তন পরিদর্শনে এসে বলেছেন, করোনা ভাইরাসের বিস্তার মোকাবেলার পাশাপাশি এই মূহুর্তে উপজেলার বোরো ধান নিরাপদে ঘরে তুলে আনাকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আর এলক্ষ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসজনিত কারণে সৃষ্ট শ্রমিক সংকট ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় দ্রুত ধান কর্তন ও মাড়াইয়ের জন্য সরকারের আর্থিক সহায়তায় কৃষকদের মাঝে কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রটি বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ২ হাজার ৬ শত ৩৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ইরি দেশী জাত ২৮, ২৯, ৫০, ৮১, ৮৮, ৮৯ ছাড়াও হাইব্রিড এসএলএইচডি, দোয়েল জাতের ধানের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এ বছর দেশী জাত প্রতি হেক্টর জমিতে ৬/৭ টন ও হাইব্রিড প্রতি হেক্টর ৯/১০ টন উৎপাদন হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখতে পাওয়া যায়, এখানে নিচু এলাকায় আবাদ করা দেশি ও ব্রি-২৮ জাতের ধান কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা। এছাড়াও মাঠ জুড়ে আধাপাকা ধানের সমাহার। আড়ালিয়া গ্রামের কৃষক মনির হোসেন জানান, খরার মধ্যেও এই বছর বোরো ধানের ফলন অনেক ভাল হয়েছে। তবে সব ধান ঘরে তোলা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার তৌফিক আহমেদ নূর জানিয়েছেন, এবার গজারিয়া উপজেলায় বোরা ধানের ভালো ফলন হয়েছে বলা চলে। খরার মধ্যে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশী হলেও আমরা আশাবাদী কৃষক তার আশানুরূপ ফলন ঘরে তুলতে পারবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী একমাসের মধ্যে সব ধান ঘরে তোলা সম্ভব।