নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জ জেলার শীতল পাটির কারিগররা ভালো নেই। আধুনিক যুগে কদর কমেছে শীতল পাটির। একটা সময় ছিল বাঙালির রোজকার জীবনে শীতল পরশ বোলানো শীতল পাটির চাহিদা ছিল সবার ওপরে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঁচামালের ঊর্ধ্বমুখী দাম, বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো নেই মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার কুটির শিল্পীরা। বাঙালির প্রাণ ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে শীতল পাটিকে রক্ষা করা উচিত। তবে অভাব অনটন এবং নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও ঐতিহ্য ধরে রাখতে চারশ’ বছরের এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখছেন পাইট্যাল পাড়ার পাটি শিল্পীরা।
টঙ্গীবাড়ীর আব্দুল্লাহপুর পাইট্যাল পাড়ায় বহু আগে থেকেই শতভাগ শিল্পী পাটি বানানোর ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় প্রতিদিনই নানা আল্পনায় শীতল পাটি বানাচ্ছেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিমাণ কমে এখন ১৫ থেকে ২০ ভাগ শিল্পী ধরে রেখেছেন এই পেশা। শীতল পাটি তৈরির প্রধান কাঁচামাল এই অঞ্চলে না থাকায় সিলেট থেকে নিয়ে আসতে হয়। শীতল পাটিতে বসে বা শুয়ে যে আরামপ্রদায়ী শীতল অনুভূতি পাওয়া যায় তা ব্যাখ্যা করা যায় না। শহরে বিয়ের অনুষ্ঠানে কনের আসনে শীতল পাটির ব্যবহার কমে এসেছে।
পাটিকর মুহিদ রাজবংশী জানান, বহু আগে থেকেই এই পেশার সঙ্গে জড়িত থেকে পরিবারের যাবতীয় চাহিদা মিটিয়ে আসছি। বাঙালির ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে হলে ও পরিচয়কে জানতে হলে এর বিকাশ বাড়াতে হবে। এই অঞ্চলের মানুষ বংশপরম্পরায় এই পেশাকে ধরে রেখেছে অভাব অনটনের মধ্য দিয়েও। বাজারে এখন শীতল পাটির চাহিদা নেই বললেই চলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে মানুষের রুচির এবং এখন আর এতে আগ্রহ নেই বললেই চলে। শহরের মানুষের সেকেলে ঐতিহ্য ধরে রাখতে আগ্রহ না থাকায় কমে এসেছে এর চাহিদা এবং ফুরিয়ে গেছে কদর।
পাটিকর জাবেদ জানান, দুই আঁটি মোতরা ছেঁটে সরু করে বিভিন্ন আকারের বেতি বানিয়ে তৈরি হয় একটি পাটি। ২০০ টাকায় কিনতে হয় দুই আঁটি মোতরা। এতে করে প্রতিটি পাটি তৈরিতে খরচ হয় ৩৫০-৪০০ টাকা। যা বাজারে বিক্রি করে ৫০ টাকার অধিক মুনাফা অর্জন করতে হিমশিম খেতে হয়। সরকারি ও বেসরকারিভাবে কোন সাহায্য সহযোগিতা আসেনি এখানে।
পাটিকর রানী বালা জানান, স্বামীকে সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে এই কাজ করে আসছি। পরিবারের যাবতীয় চাহিদা এর মাধ্যমেই পূরণ হয়ে থাকে। তবে সবকিছু মিলিয়ে লাভের পরিমাণ এখন আর আসছে না।
ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে শীতল পাটির স্বীকৃতি আছে। একটা সময় ছিল যখন বাজারে নিয়ে যাওয়ার আগেই বিক্রি হয়ে যেতো। এছাড়া বিভিন্ন জেলার মানুষ অর্ডার দিয়ে যেতো। কিন্তু বর্তমানে ভিন্ন চিত্র। বাজারে নিয়ে গেলেও ক্রেতা সমাগম নেই বললেই চলে। পাটি তৈরির সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে ভীড় জমাতো এখানে। তবে এই চিত্র এখন অতীত।
মুন্সীগঞ্জ জেলার প্র্যাটন শিল্প এবং ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করে থাকে কালের ছবি নামে একটি সংগঠন। কালের ছবির সভাপতি আনমনা আনোয়ার জানান, বহু আগে থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের একটি বিশাল অংশ এই শীতল পাটি তৈরি করে আসছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে পাটিকরদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্পের ঐতিহ্য। সকালের কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতো টঙ্গীবাড়ীর আব্দুল্লাপুর পাইট্যাল পাড়ার নারী পুরুষের পাটি বানানোর কর্মব্যস্ততা। এখন আর সেই চিত্র নেই বললেই চলে এবং এই অঞ্চলের সুনাম এখন অনেকাংশে কমে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে রুচির। তাই শীতল পাটির জৌলুস কমে এসেছে। প্রশাসন এবং সকলের মিলিত উদ্যোগই পারে এই ঐতিহ্যের ধারবাহিকতা টিকিয়ে রাখতে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল জানান, এই অঞ্চলে শীতল পাটির কাঁচামাল নেই। উদ্যোক্তাদের সিলেট থেকে অধিক দামে কাঁচামাল কিনে আনতে হয়। কৃষিবিভাগের সাথে কথা বলে এই অঞ্চলেই কাঁচামাল চাষের বিষয়টি দেখা হচ্ছে। পাটি শিল্প যাতে এই অঞ্চলের চারদিকে আরও ছড়িয়ে পড়ে সেই লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।