আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রথমে করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে দ্বন্দ্ব, তার ওপর কয়েকদিন থেকে উঠে এসেছে হংকং ইস্যু; ফলে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের একগাদা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা, বিনিয়োগকারী ও অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের মাথায় জেঁকে বসেছে দুশ্চিন্তা- এ দ্বন্দ্বের ফলে কতটা মূল্য চুকাতে হবে তাদের?
বুধবার দু’টি বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ঘোষণা দিয়েছেন, হংকং আর চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নেই। এর কিছুক্ষণ পরেই উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতনের অভিযোগে চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার অনুমোদন দিয়েছে মার্কিন কংগ্রেস। এছাড়া হুয়াওয়ের মতো তালিকাভুক্ত চীনা প্রতিষ্ঠানসহ যেসব ব্যাংক হংকং বিষয়ে হস্তক্ষেপকারী চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যবসা করছে তাদের টার্গেট করে তৈরি বিলগুলোও পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
চীনের বাণিজ্য বা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মতো অনেক ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের হাতে। তবে তারা যেটাই করুক না কেন তার প্রত্যেকটিরই সমুচিত জবাব দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীন।
শেয়ারবাজার
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেয়া লকডাউন শিথিল ও অভূতপূর্ব সরকারি প্রণোদনার সাহায্যে সম্প্রতি চাঙ্গা হতে শুরু করেছে শেয়ারবাজার। তবে এর মধ্যেই জেঁকে বসেছে নতুন শঙ্কা।
হংকং নিয়ে উত্তেজনা শুরুর প্রেক্ষিতে গত বুধবার বৈদেশিক বাণিজ্যে রেকর্ড পরিমাণ নিম্নমুখী প্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে চীনা ইউয়ানে। ব্যাপক হারে চীনা গ্রাহক ও প্রস্তুতকারকদের ওপর নির্ভরশীল কোম্পানি অ্যাপলের শেয়ারের দর কমে গেছে এসঅ্যান্ডপি৫০০-এর সূচকে।
সিসিবি ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের হেড অব স্ট্র্যাটেজি ক্লিফ ঝ্যাও বলেন, ‘উত্তেজনা চলতে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যেই হংকংয়ের হ্যাংসেং সূচক ১০ শতাংশেরও বেশি পড়ে যেতে পারে, যা হবে অন্তত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধস।’
অর্থনীতি
ট্রাম্প যদি হংকং ইস্যুতে কঠোর নীতিতেই অবিচল থাকেন তাহলে এর জন্য চীন-যুক্তরাষ্ট্র উভয়কেই বড় মূল্য চুকাতে হতে পারে। হংকং বিশ্বের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে এ শহর থেকে। তাছাড়া মার্কিন কোম্পানিগুলোকে চীনের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রেও নিরাপদ পথ তৈরি করে দেয় হংকং। ২০১৮ সালের হিসাবে অন্তত ২৯০টি মার্কিন কোম্পানির আঞ্চলিক সদর দপ্তর এবং আরও ৪৩৪ কোম্পানির আঞ্চলিক অফিস রয়েছে এ শহরে।
তবে হংকং যুক্তরাষ্ট্রে যেসব পণ্য রপ্তানি করেছে তার ৯৯ শতাংশই তাদের নিজস্ব নয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই তৈরি হয়েছে চীনে।
আবার বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনও অনেকটাই হংকং নির্ভর। ২০১৮ সালে দেশটির ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অ-আর্থিক বিনিয়োগের ৫৩ শতাংশই গেছে হংকং হয়ে। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অন্তত সাত শতাংশ সম্পত্তি রয়েছে এ শহরে। আলিবাবা, পেট্রোচায়নার মতো শীর্ষস্থানীয় চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো হংকংয়ের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। ২০১৫ সালে হংকংয়ে শেয়ার কেনাবেচা থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে চীনা কোম্পানিগুলো।
যুক্তরাষ্ট্র কোনও ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিলে সব পক্ষই সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লষকরা।
ব্যাংক
বিশ্বের প্রায় সব বড় বড় ব্যাংকগুলোরই শাখা ও সম্পত্তি রয়েছে হংকংয়ে। তবে প্রবৃদ্ধির বড় উৎস হয়ে ওঠায় তাদের অনেকেই ধীরে ধীরে চীনের মূল ভূখণ্ডমুখী হচ্ছে।
ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও চীনা বাজারে শেয়ারের পরিমাণ বিশাল। গোল্ডম্যান স্যাশ গ্রুপের ধারণা, ২০২৬ সালের মধ্যেই চীনের ব্রোকারেজ শিল্প ৪৭ বিলিয়ন ডলার লাভ করবে, এর একটা বড় অংশই দখল করতে পারে বিদেশি সিকিউরিটিজ ফার্মগুলো।
কোম্পানি
চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বে ক্ষতির মুখে পড়বে অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। চলতি মাসে হুয়াওয়ের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নতুন বিধিনিষেধ আরোপের পর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদক হু শিজিন জানিয়েছিলেন, চীন এমন একটি ‘অবিশ্বস্ত সত্ত্বার তালিকা’ ব্যবহার করে প্রতিশোধ নেবে যা গত বছর বাণিজ্যযুদ্ধের সময় প্রথম হুমকি তৈরি করেছিল।
চীন যদিও কখনোই ওইসব কোম্পানির নাম প্রকাশ করেনি, তবে সূত্রের বরাতে গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ স্থানীয় অ্যাপল ও কোয়ালকমের মতো কোম্পানিগুলোকে টার্গেট করা হতে পারে। ২০১৯ সালে চীন থেকে ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করা বোয়িং ও চীনে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম চালানো মার্কিন গাড়ি নির্মাতা টেসলাও এই তালিকার মধ্যে পড়তে পারে।
হংকংয়ের প্রুডেনসিয়াল ব্রোকারেজ লিমিটেডের সহযোগী পরিচালক আলাভিন চিউংয় বলেন, যারা চীন ও হংকংয়ের মধ্যে শেয়ার বাছাইয়ের চেষ্টা করছেন তাদের আলিবাবা ও টেনেসেন্ট হোল্ডিংসের মতো ঘরোয়া বাজারে শক্ত অবস্থানে থাকা কোম্পানিগুলোর দিকে যাওয়া উচিত এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বে ঝুঁকিতে থাকা কোম্পানিগুলো পরিহার করা উচিত।
তিনি বলেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগপর্যন্ত অস্বাভাবিকই থাকবে এবং হংকং সেই গর্তের মধ্যে পড়বে। তার মতে, সামনের পথ অনেক কঠিন হতে চলেছে। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের কঠিন অনিশ্চয়তার জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত।
সূত্র: ব্লুমবার্গ