নিজস্ব প্রাতবেদক : দেশে বিদ্যমান বিনিয়োগ স্থবিরতায় বেকারত্ব আরো তীব্র হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। বর্তমানে দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগেই স্থবিরতা নেমে এসেছে। মূলত দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আমদানি বিধি-নিষেধ, ডলার ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বিদ্যমান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো মন্দায় ভুগছে। সব মিলিয়ে আস্থাহীনতায় বিনিয়োগকারীরা পড়েছেন। ফলে গত ১৪ বছরের মধ্যে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, যে কোনো দেশে বিনিয়োগ কর্মসংস্থানের প্রধান চালিকাশক্তি। বেশি বিনিয়োগ হলে উৎপাদন বেশি হয় এবং ওই অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এদেশে কর্মসংস্থানের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগ। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময় থেকে বিনিয়োগ কমায় কর্মসংস্থানও কমছে আর বেকারত্ব বাড়ছে। বিনিয়োগকে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে দেখা হয়। দেশে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের হার ২৩.৫১ শতাংশ, যা আগের অর্থবছর ছিল ২৪.১৮। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমেছে। আর এখনো গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের হিসাব চূড়ান্ত হয়নি। তবে কতটা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে, কাঁচামাল কতটা আসছে, ঋণ বিতরণ কতটা বেড়েছে এসব সূচকেই বিনিয়োগ কমার চিত্র ফুটে উঠেছে।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে দেশে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। দাবি আদায়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঠপর্যায়ে আন্দোলন করছে, শিল্প-কারখানায় শ্রমিকপক্ষের অসন্তোষ, নিয়ন্ত্রণে আসেনি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। মব সন্ত্রাসে বিরাজ করছে সামাজিক অস্থিরতা। সব মিলিয়েই দেশে বিনিয়োগের অবস্থাও নাজুক। ফলে শিল্পের উৎপাদন কমতে থাকায় বাড়ছে বেকারত্বের হার। সদ্যাবিদায়ি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে কমেছে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ ৯১ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) ছিল ১২৭ কোটি ডলার। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১৪১ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। তাছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৬০ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। তার আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৭১ কোটি ডলার। করোনার সময়ে ২০২০-২১ অর্থবছরেও বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১৩২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনিয়োগ এসেছিল ১২০ কোটি ডলার। করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিনিয়োগ এসেছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। কিন্তু বর্তমানে গত ১৪ বছরের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরেও দেশে ১২০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। এরপর আর কোনো অর্থবছরে এর চেয়ে কম বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। এবার সেটা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সূত্র আরো জানায়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ ও পুনর্বিনিয়োগে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম বিনিয়োগ পেয়েছে। গত অর্থবছরের শুরুতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে প্রথম প্রান্তিকে মাত্র ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। আর ছয় মাসে ৫৯ কোটি ডলার হয়েছিল। গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২১ কোটি ডলার। আর আগের বছরের প্রথম ছয় মাসেই এসেছিল ৩৩ কোটি ডলার। ওই হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৩৭ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের চেয়ে বিদেশিদের পুনর্বিনিয়োগ বেশি হয়েছে। প্রথম ছয় মাসে পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি ডলার। মূলত রাজনৈকি পটপরিবর্তনের পর দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কমতে থাকে। আর দেশে যে মব সন্ত্রাস শুরু হয়েছে তা এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে ভরসা পাচ্ছে না। মূলত দেশে ব্যবসার মন্দা থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবেন না। বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতির অবনতিতে দেশের ব্যবসা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাত বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচটি বড় বাধার কথা তুলে ধরেছে। সেগুলো হলো বিদ্যুতের সমস্যা, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য ও উচ্চ করহার। বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ঋণের উচ্চ সুদহার নতুন করে বিনিয়োগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ১৬ শতাংশ সুদের কারণে নতুন বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। তাতেই দেশে বিনিয়োগ কমার প্রমাণ মেলে। পাশাপাশি উচ্চ সুদের হারের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ নেয়াও কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬.৯৫ শতাংশ, যা অন্য সময়ে ১০ শতাংশের বেশি থাকে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগ হয়েছিল এক হাজার ২৮৫ কোটি ডলার। ওই বছর দেশে পাঁচ লাখ তিন হাজার ৬৬২ জনের কর্মসংস্থান হয়েছিল। এর পরের অর্থবছরগুলোতে আর এতো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৯৯ কোটি ডলার বিনিয়োগে এক লাখ ৮০ হাজার ৭৮৬ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বড় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের আশা তলানিতেই রয়েছে। এমনকি কর্মসংস্থান তৈরিতে দেশীয় বিনিয়োগের অবদান তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও বিদেশি বিনিয়োগের মতো দেশি বিনিয়োগও বাড়ানো যায়নি। বাস্তবে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মব সন্ত্রাসে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে।
অন্যদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বিষয়ে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে সার্বিক বিনিয়োগই কমে এসেছে। শুধু বিদেশি নয়, এখন দেশি বিনিয়োগও কমেছে। দেশ এক ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহ করছে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী ঝুঁকি নিতে রাজি নন। বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কৌশল অনুসরণ করছে। আর শুধু এদেশেই নয়, সারা বিশ্বে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। বিনিয়োগ সম্মেলনে অঙ্গীকার এলেও সব বিনিয়োগকারী অপেক্ষা করছে। সার্বিক পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগ সমপ্রসারণে যাচ্ছে না। তা ছাড়া দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর বেশির ভাগই ভালো নেই। যে কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ধীরস্থিরভাবে এগোচ্ছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে বিনিয়োগ বাড়বে। বিদেশিরা এলে বন্দর ব্যবস্থাপনায় গতি বাড়বে। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিদেশিরা বন্দর ব্যবস্থাপনা করবে। তারপর মেয়াদ শেষ হলে তারা চলে যাবে।
দেশে বিদ্যমান বিনিয়োগ স্থবিরতায় বেকারত্ব আরো তীব্র হওয়ার শঙ্কা
আগের পোস্ট