নিজস্ব প্রতিবেদক
পদ্মা সেতুর ২১ তম স্প্যান বসেছে। আর এই পদ্মা সেতুর ২১ তম স্প্যান ৬-বি সেতুর ৩২ ও ৩৩ নম্বর পিলারের উপর বসানোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হলো ৩.১৫ কি.মি। পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকার সেতুর কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের চেষ্টায় সফলভাবেই স্প্যানটি বসানো সম্ভব হয়েছে। এ স্প্যান বসানোর মধ্যে দিয়ে অর্ধেকেরও বেশি দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতু। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৩২ ও ৩৩ নম্বর খুঁটির ওপর ২১ তম (সুপার স্ট্রাকচার) স্প্যানটি বসানো খবরে আনন্দের বন্যা বইছে জাজিরা প্রান্তের মানুষের মাঝে। গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৩টা ৩ মিনিটে জাজিরা প্রান্তে ২১ তম স্প্যানটি বসায় এ সেতুর প্রকৌশলীরা। স্প্যানটি স্থায়ীভাবে বসানোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হলো সেতুর ৩ হাজার ১৫০ মিটার অবকাঠামো। ২০ তম স্প্যান বসানোর ১৪ দিনের মাথায় বসলো সেতুর ২১ তম স্প্যানটি। পদ্মা সেতুর সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর জানান, ২১ তম ‘৪-সি’ স্প্যানটি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার (মাওয়া) কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে থেকে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯ টায় রওনা হয় ভাসমান ক্রেন তিয়ান-ই। মাওয়া থেকে ধূসর রংয়ের ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ হাজার ১৪০ টন স্প্যানটি ৩ হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতার তিয়ান-ই ভাসমান ক্রেন নেওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা স্প্যান বসানোর কর্মযজ্ঞ শুরু করে। কয়েক ঘন্টার প্রচেষ্টা চালিয়ে বিকাল ৩ টা ৩ মিনিটে স্প্যানটি বসাতে সক্ষম হন সেতুর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। এর আগে চলতি মাসের ১২ জানুয়ারি এ স্প্যানটি বসানোর কথা থাকলেও বসানো সম্ভব হয়নি। আর এসব তথ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর এক দায়িত্বশীল প্রকৌশলী জানান, সেতুর ২১ তম স্প্যান বসানোর প্রাথমিক তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১২ জানুয়ারি। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কারণ সেতুর ৪০০ কেবি বৈদ্যুতিক লাইনের পাইল ড্রাইভ চলছিলো। আর এর বৈদ্যুতিক লাইনটি মাওয়া ফেরি ঘাটের ওই দিক দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে সেতুর ক্রেনগুলো ছিল। এগুলো সরিয়ে আনতে ক’দিন সময় লেগেছে। তাই নির্দিষ্ট সময়ের থেকে স্প্যানটি বসাতে একটু সময় বেশি লেগে গেলো। তবে বছরের প্রথম স্প্যান বসাতে বিলম্ব হলেও চলতি মাসে (জানুয়ারি) যে তিনটি স্প্যান বসানোর পূর্ব পরিকল্পনা ছিল তা সম্ভব বলে তিনি আশা করেন। তিনি আরও বলেন, ২১ তম স্প্যানটি ছাড়াও ২০ জানুয়ারি ‘১-ই’ নম্বর স্প্যানটি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের ৪ ও ৫ নম্বর খুঁটিতে ও ৩০ জানুয়ারি ‘৬-ই’ নম্বর স্প্যানটি শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের ৩১ ও ৩২ নম্বর খুঁটিতে বসানোর কথা রয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রকৌশল সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতুতে মোট ৪২টি পিলারের মধ্যে বর্তমানে কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৩৫ টির। সেতুতে ২ হাজার ৯৫৯ টি রেলওয়ে স্ল্যাব ও ২ হাজার ৯১৭ টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসবে। পদ্মা সেতুর মোট ৪১টি স্প্যানের মধ্যে চীন থেকে মাওয়ায় এসেছে ৩৩ টি স্প্যান। এর মধ্যে ২১ টি স্প্যান স্থায়ীভাবে বসে গেছে।
সেতুর প্রকৌশলীদের তথ্য মতে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির ওপর প্রথম স্প্যান, ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ৩৮ ও ৩৯ নম্বর খুঁটির ওপর দ্বিতীয় স্প্যান, ১১ মার্চ ৩৯ ও ৪০ নম্বর খুঁটির ওপর তৃতীয় স্প্যান এবং ১৩ মে ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটির ওপর ৪র্থ স্প্যান, একই বছরের ২৯ জুন ৫ম স্প্যান বসানোর পর জাজিরা প্রান্তে মূল সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান হয় ৭৫০ মিটার। অপরদিকে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর মাওয়া প্রান্তে দু’টি খুঁটির ওপর ৬ষ্ঠ স্প্যান বসানোর পর উভয় প্রান্ত মিলিয়ে মূল সেতুর অবয়ব রূপ নেয় ৯০০ মিটারে।
আর গতবছর ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি জাজিরা প্রান্তের ৩৬ ও ৩৭ নম্বর খুঁটির ওপর ৭ম স্প্যান স্থাপনে উভয় প্রান্ত মিলিয়ে দৃশ্যমান হয় ১ হাজার ৫০ মিটার। ২০ ফেব্রুয়ারি জাজিরা প্রান্তে ৩৫ ও ৩৬ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ‘৬-ই’ নম্বর ৮ম স্প্যান। মূল সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান হয় এক হাজার ২শ মিটার। ২১ মার্চ একই প্রান্তের ৩৪ ও ৩৫ নম্বর খুঁটির উপর ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ‘৬-ডি’ নম্বরের ৯ম স্প্যান বসানোর পর অবকাঠামো আরও এক ধাপ বৃদ্ধি পেয়ে দৈর্ঘ্যে রুপ নেয় এক হাজার ৩৫০ মিটারে। ১০ এপ্রিল মাওয়া প্রান্তে ১৩ ও ১৪ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ‘৩এ’ নম্বরের পদ্মা সেতুর ১০ম স্প্যান। সেতুর মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হয় দেড় কিলোমিটারে। ২৩ এপ্রিল জাজিরা প্রান্তে ৩৩ ও ৩৪ নম্বর খুুঁটির উপর বসানো হয় ১১ তম স্প্যান। এ স্প্যানটি বসানোর পর পদ্মা সেতুর মূূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হয় ১ হাজার ৬৫০ মিটার। ৬ই মে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝামাঝি স্থানে পদ্মা সেতুর ২০ ও ২১ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ১২তম স্প্যান। ২৫ মে মাওয়া প্রান্তের ১৪ ও ১৫ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ১৩তম স্প্যান। ফলে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়ে উঠে এক হাজার ৯৫০ মিটার। পরে ১৪ অক্টোবর জাজিরা প্রান্তের ২৮ ও ২৯ নম্বর খুুঁটির ওপর স্থাপন করা হয় ১৪ মে স্প্যান এবং ২২ অক্টোবর জাজিরা প্রান্তের ২৮ ও ২৯ নম্বর খুঁটির ওপর ১৫তম স্প্যান বসানো হয়। আর এ স্প্যান বসানোর ২৮ দিনের মাথায় মাওয়া প্রান্তের ১৬ ও ১৭ নম্বর খুঁটির ওপর ১৬ তম স্প্যান বসানোর পর মূল সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ২ হাজার ৪০০ মিটারে। ২৬ নভেম্বর জাজিরা প্রান্তের ২২ ও ২৩ নম্বর খুুঁটির ওপর ‘৪ডি’ নম্বরের ১৭ তম স্প্যান বসানোর পর পদ্মার সেতুর মূল অবকাঠামো ২৫৫০ মিটার বা আড়াই কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ১১ ডিসেম্বর জাজিরা প্রান্তের ১৭ ও ১৮ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় পদ্মা সেতুর ১৮তম স্প্যান। ১৮ ডিসেম্বর ১৯তম স্প্যান বসানো হয় ২১ ও ২২ নম্বর খুঁটির ওপর। মূল সেতুর অবকাঠামো দৈর্ঘ্যে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ২ হাজার ৮শ ৫০ মিটারে। গত বছরের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর মাওয়া প্রান্তের ১৮ ও ১৯ নম্বর খুঁটির ওপর ধূসর রঙের ‘৩-এফ’ নম্বরের ২০ তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে সেতুর ৩ কিলোমিটার। আর এ বছরের প্রথম মাসের ১৪ জানুয়ারি জাজিরা প্রান্তের ৩২ ও ৩৩ নম্বর খুঁটির ওপর ধূসর রঙের ‘৪-সি’ নম্বরের ২১ তম স্প্যান বসানো হয়েছে। এ স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়ে উঠলো ৩ হাজার ১৫০ মিটার।
উল্লেখ্য, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দ্বিতল পদ্মা সেতুতে সব মিলিয়ে ৪২ টি খুঁটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তে ২১ টি ও জাজিরা প্রান্তে ২১ টি খুঁটি। আর ৪২টি খুঁটির ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। এর মধ্যে ৪০ টি খুঁটি থাকবে পানিতে আর ডাঙায় ২টি খুঁটি। ডাঙায় থাকা দু’টি খুঁটি সংযোগ সড়কের সঙ্গে মূল সেতুকে যুক্ত করবে। ছয়টি মডিউলে বিভক্ত থাকবে সেতু। মাওয়া প্রান্তে এক হাজার ৪৭৮ মিটার ভায়াডাক্ট (ঝুলন্ত পথ) থাকবে। জাজিরা প্রান্তে থাকবে এক হাজার ৬৭০ মিটার। বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতল পদ্মা সেতুর পুরোটাই নির্মিত হবে স্টিল ও কংক্রিট স্ট্রাকচারে। সেতুর ওপরে থাকবে কংক্রিটিং ঢালাইয়ের চার লেনের মহাসড়ক আর তার নিচ দিয়ে যাবে রেললাইন। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড মূল সেতু নির্মাণের কাজ করছে।