নিজস্ব প্রতিবেদক
বিক্রমপুরের ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের দৌহিত্রী বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ইতিহাস গবেষক শিক্ষাবিদ অধ্যাপিকা উত্তরা চক্রবর্তী প্রয়াত হয়েছেন। গত রবিবার সকাল ৬টা ২৫ মিনিটে কলকাতার সল্টলেকের বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তার স্বামী অধ্যাপক সুবাস রঞ্জন চক্রবর্তী। তার প্রবাসে দুই পুত্র রয়েছে। তিনি মৃত্যুকালে এক নাতনিসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। কলকাতা শহরের ইতিহাস নিয়ে তার অসংখ্য লেখা আছে। তার ইতিহাস চর্চায় গুরুত্ব পেয়েছে মুসলিম নারী। অধ্যাপিকা উত্তরা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪৪ সালে। বেথুন কলেজের অধ্যাপিকা হিসেবেই তার বেশি পরিচিতি, তবে পড়িয়েছেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজেও। সরকারি কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেওয়ার আগে অধ্যাপনা করেছেন দার্জিলিংয়ের লোরেটো কলেজে। সেখানেই তার অধ্যাপনার সূচনা হয়। অবসরের পর পড়িয়েছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েও। প্রেসিডেন্সি কলেজেই তার পড়াশোনা। স্কুল শিক্ষা সেন্ট জন ডায়াসেশন স্কুলে। ইতিহাসের অধ্যাপিকা উত্তরা চক্রবর্তীর বিশিষ্টতা তার ছাত্রদের প্রিয় এই অধ্যাপিকার পড়ানো আর গবেষণার উদ্দেশ্যই বোধহয় ছিল ভাবী প্রজন্মকে ইতিহাস পাঠ আর গবেষণায় আগ্রহী করে তোলা। তার নিজের আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত। শহরের ইতিহাস, বিশেষ করে কলকাতার ইতিহাস চর্চা ছিল তার পড়াশোনার এক বড় জায়গা জুড়ে। কলকাতার আদিপর্ব, সুতানুটি, গোবিন্দপুর, শহরের বণিক, শেঠ বসাক, শিমলা বাজার প্রভৃতি বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনি। শুধু ‘শহর কলকাতার উপাখ্যান’ রচনা করেননি তিনি, চর্চা করেছেন নারী ইতিহাস। মেয়েদের কলেজে পড়ানোর অভিজ্ঞতা হয়তো তাকে প্ররোচিত করেছে উচ্চশিক্ষায় নারীর ইতিহাস অনুসন্ধানে। সেইলক্ষ্যে সম্পাদনা করেছেন উইমেন্স এডুকেশন এন্ড পলিটিকস্ অব জেন্ডার, ইন দ্য ফুটস্টেপস অব চন্দ্রমুখী, বেথুন কলেজের ১২৫ বছরের স্মারক গ্রন্থ। দেশের আর এক ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক সোসাইটির ২২৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ ‘টাইম পাস্ট এন্ড টাইম প্রেজেন্ট’-এর সম্পাদনার কাজও করেছেন তিনি। আবার বেথুন কলেজে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সঙ্গে যুক্ত থেকে ইন্ডিয়ান আর্কিয়োলজিক্যাল সোসাইটির বুলেটিন পুরাবৃত্তে লিখেছেন ‘আর্কিয়োলজি অব ক্যালকাটা: এভিডেন্স ফ্রম বেথুন কলেজ’। তার মানবী বিদ্যাচর্চায় গুরুত্ব পেয়েছে মুসলিম নারী; লিখেছেন রোকেয়াকে নিয়ে। মধ্যযুগের ভারত ছিল তার অধ্যাপনা আর অধ্যয়নের আরও এক আগ্রহের জায়গা। পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের ২০০৫ সালের অধিবেশনে মধ্যযুগের ভারত বিভাগে সভাপতিত্ব করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন ‘নদী বসতির পটভূমি ও শহর’ নিয়ে। নব্বইয়ের দশকে বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চার গোড়ার যুগে লিখেছেন সুলতানি আমলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা নিয়ে। তার শেষ বড় কাজ বিক্রমপুরের ইতিহাস-এর রচয়িতা যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তর (১৮৮২-১৯৬৪) জীবনীগ্রন্থ ‘পথচারী ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত’ (সম্পর্ক, ২০১৮)। বিশিষ্ট ইতিহাসকার যোগেন্দ্রনাথের দৌহিত্রী হিসেবেই শুধু নয়, উত্তরকালের ইতিহাসকার হিসেবে এক বড় কাজ করে গেছেন তিনি যোগেন্দ্রনাথের জীবন ও কাজের বিশ্লেষণ আর তার সঙ্গে তার বিস্তৃত গ্রন্থপঞ্জি রচনা করে। উত্তরা চক্রবর্তীর দুই ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনা করেন। মায়ের মৃত্যুতে তারা আসতে পারছেন না কলকাতায়। উত্তরা চক্রবর্তী কিডনির সমস্যায় বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন। হাসপাতালে ভর্তির পর তার করোনার নমুনা পরীক্ষা হলে প্রথম পজিটিভ রিপোর্ট এলেও পরবর্তীকালে তা নেগেটিভ আসে। গত রবিবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।