নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় অপর একটি লঞ্চ ডুবে যাওয়ার ঘটনায় ৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ৩১ জনই মুন্সীগঞ্জের। এ দূর্ঘটনায় মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে গ্রামে চলছে শোকের মাতম। বুকফাটা আর্তনাদের শব্দে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মর্নিং বার্ড নামে ওই লঞ্চটি মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে আসছিল। গত সোমবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে শ্যামবাজারের কাছে নদীতে ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। সাঁতরে কয়েকজন তীরে উঠতে পারলেও বেশিরভাগ মানুষ ডুবে যায়। এরপর শুরু হয় উদ্ধার কাজ। এ নৌ দূর্ঘটনায় যারা মারা গেছেন: শাহাদাত হোসেন (৪৪), আবু তাহের বেপারী (৫৮), সুমন তালুকদার (৩৫), ময়না বেগম (৩৫), তার মেয়ে মুক্তা আক্তার (১৩), আফজাল শেখ (৪৮), মনিরুজ্জামান মনির (৪২), গোলাপ হোসেন (৫০), সুবর্ণা বেগম (৩৮), তার ছেলে তামিম (১০), আবু সাঈদ (৩৯), সুফিয়া বেগম (৫০), শহিদুল ইসলাম (৬১), মিজানুর রহমান কনক (৩২), সত্যরঞ্জন বনিক (৬৫), শামীম বেপারী (৪৪), বিউটি আক্তার (৩৮), আয়শা বেগম (৩৫), মো. মিল্লাত (৩৫), মো. আমির হোসেন (৫৫), সুমনা আক্তার (৩২), পাপ্পু (৩২), মো. মহিম (১৭), দিদার হোসেন (৪৫), হাফেজা খাতুন (৩৮), হাসিনা রহমান (৩৫), সিফাত (৮), আলম বেপারী, তার ভাগ্নে তালহা (২), ইসমাইল শরীফ (৩৫), সাইফুল ইসলাম (৪২) ও বাসুদেব নাথ (৪৫)।
গত সোমবার রাতে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী ৩০ জন মুন্সীগঞ্জের এবং ১ জন ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার। ৩০ জনের মধ্যে মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার ১৯ জন, টঙ্গীবাড়ি উপজেলার ৯ জন, সিরাজদিখান উপজেলা ১ এবং শ্রীনগর উপজেলার ১ জন।
মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ মনিরুজ্জামান তালুকদার জানান, এমভি মর্নিং বার্ড নামে ওই লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের কাঠপট্টি থেকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল। গত সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে চাঁদপুর থেকে আসা ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায় মর্নিং বার্ড। জেলা প্রশাসনে নিহতদের তালিকা করা হয়েছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহজামান জানান, ৩২ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের সবার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়।
এই তালিকা অনুযায়ী:
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার নিহতরা হলেন- মিরকাদিমের গোয়ালঘুন্নির আব্দুর রহিমের ছেলে শাহাদত হোসেন (৪৮), একই গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে আবু তাহের বেপারী (৫৮), আবুল কালামের ছেলে মুন তালুকদার (৩৫), মোল্লাকান্দির মজিদ সারেংয়ের ছেলে সাইদুর হোসেন (৩৯), রিকাবীবাজার পশ্চিমপাড়ার পরশ মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া বেগম (৫০), রামপালের ধলাগাঁওয়ের মো. দেলোয়ার হোসেনের ছেলে মো. মিজানুর রহমান কনক (৩২), রামগোপালপুরের মৃত দেবেন্দ্র বনিকের ছেলে সত্যরঞ্জন বনিক (৬৫), রিকাবীবাজারের নহর দিঘীরপাড় গ্রামের মোঃ সোহরাবের ছেলে মো. পাপ্পু (৩২), মালপাড়ার হাজী আব্দুর রউফ মাদবরের ছেলে মো. সাইফুর রহমান উজ্জ্বল (৪০), রামপালের ধলাগাঁওয়ের মৃত আলাউদ্দিন শেখের মেয়ে বিউটি বেগম (৩৮), মিরাপাড়ার মৃত আব্দুল জলিলের শামীম বেপারী (৪৭), নৈদিঘীরপাড়ের আব্দুল মজিদের ছেলে মো. দিদার হোসেন (৪৫), পানহাটার আব্দুল সামাদের ছেলে মো. মিল্লাত (৩৫), রিকাবীবাজারের জাহান শরীফের ছেলে ইসলাম শরীফ (৩৫), তিলারদির আফসারুদ্দিনের ছেলে মো. সাইম (১৭), নৈদিঘীরপাড়ের আব্দুল মজিদের মেয়ে হাফেজা খাতুন (৩৮)।
টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নিহতরা হলেন: টঙ্গীবাড়ি-সোনারং গ্রামের মাসুদ শেখের দুই মেয়ে স্বর্ণা বেগম (৩৫) ও মুক্তা আক্তার (১৩), বাঘিয়ার ইব্রাহিম শেখের ছেলে আফজাল শেখ (৪৮), আব্দুল্লাহপুরের আব্দুল হালিমের ছেলে মো. মনিরুজ্জামান (৪২), রামপালের মশরী বাজারের আব্দুল হাকিম ভূঁইয়ার ছেলে গোলাম হোসেন (৫০), রামপালের সুজানগরের জাকির হোসেনের স্ত্রী সুবর্ণা আক্তার, শিশুপুত্র তামিম (১০),যশলংয়ের বাঘিয়ার মৃত ইব্রাহিম শেখের ছেলে মো. শহিদুল ইসলাম (৬৯), কামারখাড়ার খাড়ার পাচকরি বেপারীর স্ত্রী আয়শা বেগম (৬৫), টঙ্গীবাড়ি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে ময়না বেগম (৩৫), আব্দুল্লাহপুরের আব্দুর রহমানের ছেলে সিফাত (৮), আশরকাটি গ্রামের বেলায়েত হোসেনের মেয়ে তালহা (২)। এছাড়া সিরাজদিখান উপজেলার পাইকপাড়ার মৃত বাদল দেবনাথের ছেলে বাসু দেবনাথ (৪৫), শ্রীনগর উপজেলার তারাহাটি গ্রামের জয়নাল বেপারীর ছেলে আলম বেপারী (৩৮)। ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার বানাঘাটা গ্রামের মৃত রুস্তম শরীফের ছেলে আমির হোসেন (৫৫)। জানাজার পর রাতেই অনেকের দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন রাতেই স্বজনহারাদের বাড়িতে যান সহমর্মিতা জানাতে। জানাজায়ও অংশ নেন। লঞ্চডুবির প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর রাত সোয়া ১০টার দিকে বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় ১২ ঘণ্টা পর ভাসমান অবস্থায় জীবিত উদ্ধার হয় সুমন বেপারী (৩৭)। তিনি বর্তমানে ভালো আছেন। জীবিত উদ্ধারের কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস। তবে ঠিক কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ দূর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক এবং বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে গঠিত এই কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
সদরঘাটের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ময়ূর-২ এর ধাক্কায় তুলনামূলকভাবে আকারে অনেক ছোট মর্নিং বার্ডকে মুহূর্তের মধ্যে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যেতে দেখা যায়। ময়ূর-২ লঞ্চটি ঘটনার পরপরই জব্দ করা হয়েছে জানিয়ে নৌ পুলিশের প্রধান ডিআইজি আতিকুল ইসলাম বলেন, লঞ্চের মাস্টারসহ অন্যরা পালিয়ে গেছে। আমরা লঞ্চে থাকা দুইজন স্টাফকে গ্রেপ্তার করেছি। জব্দ করা লঞ্চটি এখন লালকুঠি ঘাটে আছে। বিআইডব্লিউটিএ’র পরিবহন পরিদর্শক মো. সেলিম জানান, মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ডে অর্ধশতাধিক যাত্রী ছিল বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই ভেতরে আটকা পড়েন। তবে ঠিক কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।