আরাফাত রায়হান সাকিব : খেতে যেমন সুস্বাদু, মানও তেমন খাঁটি, যে কারণে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের মিষ্টিজাতীয় খাবার পাতক্ষীরের সুখ্যাতি রয়েছে সমগ্র
দেশজুড়ে। প্রায় ২শত বছর ধরে উৎপাদিত হওয়া এ খাবারের স্বাদ পেতে দূর-দূরান্ত থেকে ভোজনরসিকদের মুন্সীগঞ্জে ছুটে আসা নিয়মিত। চাহিদা রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও।
অবশেষে এবার ঐতিহ্যবাহী খাবার “মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীর” আজ থেকে জেলার ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে। এতে বিশ্বব্যাপি মুন্সীগঞ্জের স্বতন্ত্র উৎপাদিত খাবার হিসেবে পরিচয় অর্জিত হবে। মুন্সীগঞ্জের খাবারের ঐতিহ্যের মুকুটেও যুক্ত হচ্ছে নতুন পালক। পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের আয়োজনে আজ বুধবার বিশ্ব মেধা দিবস ও নিবন্ধনকৃত ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের সনদ প্রদান অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল ৩টায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির মাল্টিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত হবে এ আয়োজন। যেখানে মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীর জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের সনদ গ্রহণ করবেন মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত। এর মাধ্যমে জেলার প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত মিলছে পাতক্ষীরের।
দৈনিক মুন্সীগঞ্জের কাগজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক। অনুষ্ঠানে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ছাড়াও মোট ৪ জন উপদেষ্টার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত জানান, সনদ গ্রহণের অনুষ্ঠানের পত্র কয়েকদিন আগেই আমরা হাতে পেয়েছি। বুধবার সনদপত্র গ্রহণ করা হবে। জেলার প্রথম জিআই পণ্যে স্বীকৃতির বিষয়টি আমাদের জন্য গৌরবের ও আনন্দদায়ক। পরবর্তীতে যারা এ পাতক্ষীরের উৎপাদনের সাথে বংশ পরম্পরায় কাজ করছেন তাদের সম্মানিত করা হবে।
তিনি আরো জানান, মুন্সীগঞ্জ নানা বিষয়ে ঐতিহ্যের স্মারক বহন করে। পাতক্ষীরের পর আড়িয়াল বিলের কুমড়া নিয়েও আমরা কাজ করবো। জেলার ঐহিত্যবাহী এই বিষয়গুলোকে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এদিকে নিজেদের পণ্য জিআই স্বীকৃতি মেলায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন সিরাজদিখানের সন্তোষপাড়া এলাকার পাতক্ষীরের কারিগররা।
মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীর :
জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে সিরাজদিখানে পুলিন বিহারী দেব ও তার স্ত্রী প্রথম নিজবাড়িতে পাতক্ষীর তৈরি করেন। এরপর ধীরে ধীরে সেটি বাজারে বিক্রি শুরু করেন পুলিন বিহারী। সুস্বাদু এই মিষ্টি খাবার তৈরি করে সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া ইউনিয়নের সন্তোষপাড়া গ্রামের ঘোষ পরিবারগুলো। কলাপাতায় মুড়িয়ে পরিবেশন করা হতো বলে প্রথম দিকে এর নামকরণ করা হয় পাতাক্ষীর। পরে পরিচিতি পায় পাতক্ষীর হিসেবে। পুলিন বিহারীর মৃত্যুর পর এখন তার উত্তরসূরিরা পাতক্ষীর তৈরি করছেন।
পাতক্ষীর প্রস্তুতকারী কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রথমে দুধ গরম করে ঢালা হয় বড় কড়াইতে। এরপর এক ঘণ্টা সেই দুধ জ্বাল দিয়ে কিছুটা ঘন করে মেশানো হয় হলুদ গুঁড়া। পরে ঘণ্টা ধরে জ্বাল দেওয়ার পর যোগ করা হয় চিনি। মিশ্রণ ঘন হয়ে এলে অনবরত নাড়তে নাড়তে প্রস্তুত করা হয় ক্ষীর। ১ পাতা পাতক্ষীর তৈরিতে দুধ প্রয়োজন হয় সাড়ে তিন কেজি। চুলায় জ্বাল দেয়ার কাজ শেষ হলে এরপর তাফাল থেকে সুবিধাজনক পাত্রে ঢেলে মাটির হাঁড়িতে গরম গরম ক্ষীর তুলে রাখা হয়। ঘণ্টাখানেক পর ঠান্ডা হলে ক্ষীরের হাঁড়িগুলো নেওয়া হয় দোকানে। নিয়মমতো ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হলে ১ মাস পর্যন্ত খাওয়ার উপযোগী থাকে পাতক্ষীর।
সিরাজদিখান বাজারের পাতক্ষীরের অন্যতম দোকান রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার।
বর্তমানে তিন ভাই শরৎ ঘোষ, মাধব ঘোষ ও খোকন ঘোষ ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
দৈনিক মুন্সীগঞ্জের কাগজকে সবার ছোট ভাই খোকন ঘোষ বলেন, বংশ পরম্পরায় পাতক্ষীর তৈরির সাথে যুক্ত তারা। তার পরিবারের ৫ পুরুষ ধরে এই মিষ্টি খাবার তৈরি করছেন। ১ পাতা পাতক্ষীর আধা কেজি পরিমাণ হয়। যা তৈরি করতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ কেজি দুধ ব্যবহার করা হয়। গরমের দিনে গড়ে প্রতিদিন ২০-৩০ পাতা এবং শীতের দিনে ২শত থেকে আড়াইশত পাতা বিক্রি করেন তিনি।
এদিকে আরো বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ইউরোপ-আমেরিকার বাঙালি কমিউনিটির অনেক বিখ্যাত মিষ্টিপণ্যের দোকান বা সুপারশপেও বিক্রি করা হয় পাতক্ষীর। তাছাড়া শীতকালে নতুন জামাইকে পিঠা-পুলির সঙ্গে এ ক্ষীর খেতে দেওয়া এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের প্রথা। তাই পাতক্ষীর ক্রয়ে ভিড় থাকে সিরাজদিখানের দোকানগুলোতে।
বর্তমানে এর দাম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
পাতক্ষীর উৎপাদনকারী মা মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক ভিকি ঘোষ বলেন, সন্তোষপাড়া গ্রামে তৈরি করে নিজেরাই বাজারে বিক্রি করি। আমরা ৩ পুরুষ ধরে ব্যবসা করছি। আমার পূর্বপুরুষেরা রাত জেগে মাটির চুলায় মণে মণে দুধ জ্বাল দিয়ে এটি তৈরি করতেন।
তিনি আরও জানান, দুধের দাম বাড়লে প্রতি পাতা পাতক্ষীরের দাম বাড়ে। আর দুধের দাম কমলে পাতক্ষীরের দামও কমে।
বর্তমানে সন্তোষপাড়া গ্রামের ৫-৬টি পরিবার পাতক্ষীর তৈরি ও বিক্রি করে। সিরাজদিখান বাজারে সবারই দোকান রয়েছে।
২০২৪ সালে আবেদন : ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বিখ্যাত মিষ্টিজাতীয় খাবার পাতক্ষীরের নিবন্ধন করা হয় ২০২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। এদিন বিকালে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এ উপলক্ষে প্রেস ব্রিফিং করেছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ আবুজাফর রিপন।
তিনি জানান, পাতক্ষীর জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন হওয়ায় আমি আনন্দিত। এর মাধ্যমে সারা বিশ্বে পাতক্ষীরের পরিচিতি উঠে আসবে অফলাইন এবং অনলাইনে। সকলে জানতে পারবে মুন্সীগঞ্জে পাতক্ষীর তৈরি হয় এবং এটি এই জেলার ব্র্যান্ড। ফলে যারা এটি উৎপাদন করছেন তাদের চাহিদাও বেড়ে যাবে। বর্তমান সরকারের সদয়ের কারণেই এটি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল। এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ। মুন্সীগঞ্জবাসীকেও শুভেচ্ছা।
জিআই কী : কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর কোনো সংস্কৃতি যদি
পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেই পণ্য ওই অঞ্চলের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তাই কোনো পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে বিবেচিত হলে এর মর্যাদা প্রাপ্তি ঘটে। কিন্তু বিষয়টি এখানেই শেষ নয়, এর বাণিজ্যিক গুরুত্বও রয়েছে। জিআই এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সুনির্দিষ্ট এলাকার পণ্যের প্রসার, গুণগত মান বৃদ্ধি এবং নকল রোধ করা। এভাবে মান অক্ষুন্ন থাকলে পণ্যের বাজার বাড়ে। এলাকার বাইরে এমনকি বিদেশেও রপ্তানিযোগ্য হয়ে ওঠে।