নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জ শহরের মধ্য কোটগাঁও এলাকায় জেসিকা মাহমুদ (১৬) নামে এক এসএসসি পরিক্ষার্থীকে মারধর ও শ্বাসরোধে হত্যা করেছে বিজয় রহমান ও তার প্রেমিকা আদিবা আক্তার। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুন্সীগঞ্জ শহর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমানের ছেলে বিজয়ের বাড়িতে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। পরে ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার কথা প্রচার করেছে ঘাতক চক্র। ঘটনার পর থেকে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টার তদন্ত শেষে চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ।
এ ঘটনায় গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় নিহত জেসিকার ভাই মো. শাহরিয়ার জিদান বাদী হয়ে হত্যাকান্ডের মূলহোতা বিজয় রহমান ও আদিবা আক্তারের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও এক থেকে দুইজনকে আসামী করে মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় হত্যা মামলা রুজু করেছে। মামলার প্রধান আসামী বিজয় রহমান মুন্সীগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আরিফুর রহমানের ছেলে ও দুই নম্বর আসামী আদিবা আক্তার পঞ্চসার ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাহিদ হাসানের মেয়ে। এর মধ্যে দুই নম্বর আসামী আদিবা আক্তারকে গতকাল বুধবার বিকেলে শহরের উপকণ্ঠ নয়াগাঁও এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আদিবা আক্তার পুলিশের কাছে দেওয়া ১৬১ ধারায় জবানবন্দিতে হত্যাকান্ডের বিবরণ তুলে ধরলে চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন হয় বলে নিশ্চিত করেছেন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তারিকুজ্জামান। এছাড়া একই মামলায় আরও ১ থেকে ২ জনকে অজ্ঞাত পরিচয় আসামী করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
নিহত জেসিকা মাহমুদ সদরের সাতানিখিল এলাকার সেলিম দেওয়ানের কন্যা। সে শহরের এভিজেএম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরিক্ষার্থী। জেসিকা মায়ের সাথে শহরের মধ্য কোটগাঁও এলাকার ভাড়া বাসায় থাকতো। গত মঙ্গলবার রাতে নিহত হওয়ার পর গতকাল বুধবার দুপুরে নিহত জেসিকা মাহমুদের মরদেহ মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে বিকেলে জেসিকার মরদেহ সদরের সাতানিখিল এলাকার গ্রামের বাড়ির সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
পুলিশ ও নিহতের পরিবার জানায়, গত মঙ্গলবার বিকেলে স্কুলছাত্রী জেসিকা মাহমুদকে শহরের মধ্য কোটগাঁও এলাকার নিজ বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায় বিজয় রহমান ও তার প্রেমিকা আদিবা আক্তার। সেখানে হ্যাক হওয়া ফেসবুক আইডি ও গোপন ভিডিও চিত্র নিয়ে উভয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। একপর্যায়ে বিজয় রহমান জেসিকা মাহমুদকে গলায় শ্বাসরোধ করে এবং তার প্রেমিকা আদিবা চাবির ছড়া দিয়ে চোখে মুখে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। এতে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর স্কুলছাত্রী জেসিকা অচেতন হয়ে পড়ে। বিষয়টি বুঝতে পেরে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গেছে বলে প্রচার চালায় এবং অচেতন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যায় বিজয় রহমান। আর বিজয়দের বাড়ি থেকেই সটকে পড়ে প্রেমিকা আদিবা আক্তার।
স্থানীয় সূত্র জানায়, জেসিকা মাহমুদের ভাই জিদানের বন্ধু বিজয় রহমান। জেসিকার সঙ্গেও সখ্যতা ছিল বিজয়ের। এই সখ্যতার সূত্র ধরেই জেসিকাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায় বিজয়।
জেসিকার ভাই ও মামলার বাদী শাহরিয়ার জিদান জানান, গত মঙ্গলবার বিকেলে বাড়ি থেকে ঘুরতে বের হয় জেসিকা। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে বাড়িতে ফিরেনি। পরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে হাসপাতাল থেকে বাড়ির পাশের প্রতিবেশী বিজয় নামের এক বন্ধু ফোন দিয়ে জানায় জেসিকার অবস্থা খারাপ। সে ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। আমরা হাসপাতালে দৌড়ে আসার পর বিজয় চলে যায়। অ্যাম্বুলেন্স তাকে ঢাকায় নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় তার। এটা হত্যাকান্ড। ওরা আমাদের বলেছে, ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। আর হাসপাতালে জানিয়েছে, পড়ে গেছে।
নিহতের মা রিনা বেগম বলেন, আমার মেয়েকে ডেকে নিয়ে অনেক নির্যাতনের পর শ্ব¦াসরোধ করে হত্যা করেছে বিজয়। আমি হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শহর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমানের ছেলে বিজয় রহমান ও কয়েকজন মিলে প্রথমে তাকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় নিয়ে আসে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। পরে ঢাকা রওনা হলে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে নিয়ে পুনরায় মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ফেরত আসেন তারা। পরে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সদর হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. শৈবাল বসাক জানান, সন্ধ্যায় ওই কিশোরীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছিলো। পরে রাত ৮টার দিকে আবার মৃত অবস্থায় মরদেহ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তার মুখসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ৫ তলার ছাদ থেকে পড়ে মরে যাওয়ার বিষয়টি আমাদেরকে জানায় হাসপাতালে নিয়ে আসা ছেলেটি। তবে এমন ঘটনা হলে রোগীর মাথায় রক্তক্ষরণের চিহ্ন থাকতো, যা এই রোগীর ছিলো না। ময়নাতদন্ত ছাড়া কিছুই বলা যাচ্ছে না।
শহর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান জানান, জেসিকা মাহমুদ কি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে এসব বিষয়ে আমি এবং আমার স্ত্রী কিছুই জানি না।
গত মঙ্গলবার রাতে স্কুলছাত্রী জেসিকা মাহমুদের হত্যার ঘটনায় বিজয় রহমান পলাতক থাকায় পুলিশ গভীর রাতে মধ্য কোটগাঁও এলাকা থেকে আটক করে তার বাবা-মাকে। তারা হলেন- মুন্সীগঞ্জ শহর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান ও মা কানিজ ফাতেমা, স্বজন ফারিয়া ও তামান্না আক্তার। গতকাল বুধবার বিকেলে হত্যার রহস্য উন্মোচন হওয়ার পর সন্ধ্যায় তাদের ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন দেব বলেন, হাসপাতাল থেকে মরদেহ পেয়ে গতকাল বুধবার দুপুরে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন শেষে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। হত্যাকান্ডের ২৪ ঘন্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে মামলার প্রধান আসামী বিজয় রহমান পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশের একাধিক টিম অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
মুন্সীগঞ্জে এসএসসি পরিক্ষার্থীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা; চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন
আগের পোস্ট