করোনার কারণে যাত্রীর সংখ্যা কম থাকলেও অদক্ষ চালকদের কারণে রয়েছে দূর্ঘটনার আশঙ্কা
নিজস্ব প্রতিবেদক
নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর অতি প্রাচীনকাল থেকেই ছিল ঐতিহ্যবাহী। বিশেষ করে এই নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের মাতলাঘাট থেকে কলকাতা পর্যন্ত বড় বড় স্টিমার চলত। তবে সেসব শুধুই এখন অতীত। এখন নারায়ণগঞ্জের লঞ্চগুলো চলছে জোড়াতালি দিয়ে। দীর্ঘদিনের পুরনো লঞ্চগুলো চলাচলের অনুপযোগী হলেও এগুলোকে জোড়াতালি দিয়ে রং মেখে নতুন দেখিয়ে অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে ফিটনেস সার্টিফিকেট নেওয়া হয়। প্রতিটি লঞ্চেই মাস্টার ড্রাইভার দেখিয়ে সার্ভে সনদ নেওয়া হলেও নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জগামী লঞ্চগুলোতে নেই মাস্টার ড্রাইভার। বরং নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ রুটের ২৫টি লঞ্চই চালাচ্ছেন সুকানি গ্রিজাররা। সূর্যাস্তের পরে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ না থাকা এবং অনুমতি না থাকলেও প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়েই শীতলক্ষ্যা ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদী পাড়ি দিচ্ছে এসব লঞ্চ। নিরাপদ নৌপথ চাই ও বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সবুজ শিকদার মাস্টার জানান, নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলোর কোনোটিরই মাস্টার ড্রাইভার নেই। এসব লঞ্চ চালাচ্ছে সুকানি গ্রিজাররা। সার্ভের সময় মালিকরা চালাকি করে ডিসপেনশন সার্টিফিকেট নিয়ে থাকে। আইএসও ১৯৭৬-এর নিয়ম অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির নৌযান সূর্যাস্তের পর চলতে পারবে না। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ থেকে চলাচলকারী লঞ্চগুলো রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্তও চলে। সার্ভের সময় যে ধারনক্ষমতা দেখানো হয় তার থেকে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো চলাচল করে। যেমন যে লঞ্চটি ৪০ জনের কনজারভেসি, আয়কর, যাত্রী কল্যাণ ট্যাক্স দেয় সেই লঞ্চটি প্রতি ট্রিপে অন্তত দেড় থেকে ২০০ যাত্রী বহন করে থাকে। প্রতিটি লঞ্চে বয়া থাকার প্রয়োজন ১২ থেকে ১৬টি। কিন্তু রয়েছে অর্ধেকেরও কম। নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল থেকে চলাচলকারী লঞ্চগুলো দীর্ঘদিনের পুরোনো। এগুলোর ফিটনেস প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু এ লঞ্চগুলোকে ডকইয়ার্ড নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে রং মাখিয়ে নতুন দেখিয়ে ফিটনেস নেওয়া হয়। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মোটা অংকের অর্থ ঘুষ দিয়ে ফিটনেসবিহীন লঞ্চকে সার্ভে সনদ দেওয়া হয়। আমরা গেল বছরের জানুয়ারিতে নিরাপদ নৌপথের দাবিতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। এরপর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি সভাতে নানা বিষয়ে সিদ্ধান্তও হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে সেসব সিদ্ধান্ত আজও বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে করোনার কারণে যাত্রীর সংখ্যা কম থাকলেও অদক্ষ চালকদের কারণে রয়েছে দূর্ঘটনার আশঙ্কা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সুকানি জানান, মালিকপক্ষের প্রলোভনে পড়ে অনেকেই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই ছোট আকারের লঞ্চগুলো চালাচ্ছেন। যে কারণে প্রায় সময়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। বিআইডব্লিউটিএ এর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের দায়িত্বে থাকা বাবু লাল বৈদ্য জানান, ৫টি রুটে ৭০টি লঞ্চ চলাচল করে থাকে। নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ রুটে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০ মিনিট পরপর লঞ্চ ছেড়ে যায়। এই রুটে ২৫টি লঞ্চ চলাচল করে। নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর রুটে ১৫টি, মতলব-মাছুয়াখালী রুটে ১৯টি, হোমনা-রামচন্দ্রপুর একটি, সুরেশ্বর-নরিয়া (শরিয়তপুর) দুটি লঞ্চ চলাচল করে থাকে। লঞ্চ মালিকরা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর থেকে সার্ভে সনদ নিয়ে লঞ্চ পরিচালনা করে থাকে। এরপর তারা রুটের বিষয়টি অনুমোদন দিয়ে থাকেন এবং ওভারলোডের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। অন্যান্য রুটের লঞ্চগুলোতে মাস্টার ড্রাইভার থাকলেও নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ রুটে সাধারণত সুকানিরাই লঞ্চ চালাচ্ছে। তবে এদের ডিজি শিপিং থেকে কোয়ার্টার মাস্টারের সনদ দেওয়া হয়ে থাকে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা মাঝেমধ্যেই শীতলক্ষ্যা নদীতে চলাচলকারী সার্ভে সনদের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন এবং অভিযান পরিচালনা করে থাকেন। তারা বিধিমালা অনুসরণ করেই এক বছরের জন্য সার্ভে সনদ প্রদান করে থাকেন। তবে যদি কোনো লঞ্চ মালিক এক মাস মাস্টার ড্রাইভার রেখে বাকি ১১ মাস তাদের না রাখে সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করণীয় থাকে না। নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল গণমাধ্যমকে জানান, ৬৫ ফুটের নিচে যেসব লঞ্চ বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলো কোয়ার্টার মাস্টার (সুকানি গ্রিজার) দ্বারা পরিচালনা করা হয়। তারা ডিজি শিপিং থেকে কোয়ার্টার মাস্টারের প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। এছাড়া চাঁদপুর ও নরিয়া রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলো সিঙ্গেল ইঞ্জিন হওয়ায় সেগুলো তৃতীয় শ্রেণির মাস্টার ড্রাইভাররা চালাতে পারেন।