নিজস্ব প্রতিবেদক
আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের জীবনমানের অগ্রগতির পথে আজ প্রাচীন ঐতিহ্যের অনেক কিছু বিলুপ্ত প্রায়। এই হারানো ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হল হাতে ভাজা দেশি মুড়ি। কালের পরিক্রমায় আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় বর্তমানে কারখানায় মুড়ি উৎপাদিত হওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু হাতে ভাজা দেশি মুড়ি। গত কয়েক বছর পূর্বেও মুন্সীগঞ্জে উপজেলার গ্রামগুলো মুড়ি পল্লীতে পরিণত ছিল। মেশিনের মুড়ির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা মুড়ি। বেকার হয়ে পড়েছেন হাতে ভাজা মুড়ির ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন। কয়েক বছর আগেও জেলার বিভিন্ন উপজেলার সহস্রাধিক পরিবার সারা বছর মুড়ি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। শীতের আগমন বার্তার আগেই গ্রামগুলোতে মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে যেতো। স্থানীয় বাজার থেকে মুড়ির ধান সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করে তারা মুড়ি ভাজতেন। পরিবারের সবাই ব্যস্ত থাকতেন এ কাজে। এখন আর বাড়িতে বাড়িতে মুড়ি ভাজা হয় না। কারণ মেশিনের মুড়ি দামে সস্তা থাকায় হাতে ভাজা মুড়ির বাজার এখন তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। ফলে তাদের অনেকেই পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। অথচ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। আবার অনেককে খরচ বেশি পড়লেও হাতেভাজা মুড়ি-ই খেতে দেখা যায়। ওসব এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাতেভাজা মুড়ি অনেক স্বাস্থ্যসম্মত। তাই খরচ একটু বেশি পড়লেও আমরা হাতে ভাজা মুড়ি-ই খাই। গাঁওদিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডাঃ আলী আহম্মেদ (দুলাল) জানান, হাইড্রোজ মিশ্রিত মুড়ি খেলে তাৎক্ষণিকভাবে শারীরিক সমস্যাসহ দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা দেখা দেয়। তাই কারখানায় তৈরি মুড়ি না খাওয়াই ভালো। লৌহজং এর ইউপি সদস্য জয়নাল আবেদীন বলেন, হাতেভাজা মুড়ি শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে এ পেশার মানুষজন এখন আর এ পেশায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তারপরেও একটি এসোসিয়েশন করে এ শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কালের বিবর্তনে বাংলার ঐতিহ্যময় অনেক কিছুই বর্তমানে স্মৃতি। আর তাই মুন্সীগঞ্জে এ হাতেভাজা মুড়ি শিল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে সরকার, এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
হাতে ভাজা মুড়ি : ধান থেকে হাতে দেশি পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজা এক জটিল প্রক্রিয়া। বিশেষ অভিজ্ঞতা ছাড়া এ কাজ করা যায় না। মুড়ির ধান মাড়াইয়ের পর তা পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। রোদে ধানের রস টানার পর তা ভাপ দিয়ে হালকা সেদ্ধ করা হয়। এরপর তা ৩-৫ দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর আবার ভাপে সেদ্ধ করা হয়। একটা বড় হাঁড়িতে পানি ফোটে। এর ওপরে ছিদ্রযুক্ত একটি পাত্রে ধান রেখে একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এতে পানির ভাপে ধান সেদ্ধ হয়। এ সময় ধানের মুখ ফাটলে তা তোলা বা নামানো হয়। সেদ্ধ ধান একটু আঠালো হলে তাতে মুড়ি ভালো হয়। সেদ্ধ করার সময় ধান যদি বেশি সেদ্ধ হয়ে ভাতের মতো গলে যায় তবে তাতে আর মুড়ি হবে না। এরপর সেদ্ধ করা ধান আবার রোদে শুকানো হয়। যখন চাল শক্ত হয়ে যায় তখন তোলা হয়। এরপর কলে বা ঢেঁকিতে ভানা হয়। তুষ-কুঁড়া পরিষ্কার করে মুড়ির চাল বানানো হয়।
মুড়ি ভাজার আগে একটি মাটির পাতিলে চালে লবণ পানি ছিটিয়ে মাখা হয়। লবণ পানি এমনভাবে মাখানো হয় যাতে সবগুলো চালে তা মাখে। মাটির পাত্রে তাপ দিয়ে এসব চাল একটা কাঠি দিয়ে অনবরত নাড়তে হয়। তাপে চালগুলো যখন লাল হয়ে ওঠে তখন পাশে আর একটি চুলায় রাখা পাত্রের গরম বালির মধ্যে ঢেলে গইর দিলে মুড়ি হয়ে যায়। পাশে ছিদ্রযুক্ত আর একটি পাত্র বা ঝাঁঝরে ঢেলে শলা দিয়ে নেড়ে মুড়ি থেকে বালিকে আলাদা করা হয়। সেসব বালি আবার চুলায় বসানো হয় ও তাতে একইভাবে মুড়ি ভাজা চলতে থাকে।