নিজস্ব প্রতিবেদক
চার শতকের ঐতিহ্যবাহী ঢাকা নগরীর ঐতিহ্যবাহী রহমতগঞ্জের গনি মিয়ার হাট। শত বছরের প্রাচীন এই হাটের প্রধান আকর্ষণ ছিল মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের বিখ্যাত কোরবানির গরু। প্রায় ৫০/৬০ বছরের আমার স্মৃতির পাতা থেকে বলছি, তবে এর অনেক আগে থেকেই ঈদুল আযহা উপলক্ষে মিরকাদিমের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই একাধিক পরিবারের গোয়ালঘর ছিল। গোয়ালে দুধের গাই পালন করা হতো পরিবারের সদস্যদের দুধের চাহিদা মিটাতে। আবার অনেকে একাধিক দুধের গাই পালন করতো বাজারে দুধ বিক্রি করে উপার্জিত টাকা দিয়ে প্রয়োজন মতো পরিবারের চাহিদা পূরণ করতো। গরুর সেই গোয়ালঘরকে আতাল বলা হতো। সেই আতালে দুধের গরু রাখার পরও কিছু জায়গা খালি রাখা হতো। সেই আতালে রমযানের ঈদের ২/১ মাস আগে থেকেই কোরবানির গরু পালন করা হতো। বিভিন্ন স্থান থেকে গরু কিনে এনে সেই গরু বানানো ( মোটাতাজা ) হত। আঞ্চলিক ভাষায় বনাইন্যা গাই বলা হতো। প্রতি পরিবার সাধ্যমতো ২/৪টি গরু মোটাতাজা করতো কোরবানির ঈদ উপলক্ষে বিক্রি করে বাড়তি উপার্জনের আশায়। তারা মনে করতো ঈদের ৩/৪ মাস পূর্বে কম দামে রুগ্ন গরু কিনে এনে লালনপালন করে ঈদের বাজারে বিক্রি করে একসাথে কিছু টাকা পাওয়া যায়, বলা চলে সঞ্চয়ের মতো। আবার কেহ কেহ ব্যবসায়িকভাবে ২০/৩০টি পর্যন্ত কোরবানির গরু পালন করতো। এই গরুগুলোর মধ্যে অধিকাংশই থাকতো গাই গরু, বেশি গরুই ছিল ধবধবে সাদা, কিছু গরু ধূসর রঙের ও কালো, লাল রঙেরও থাকতো, ষাঁড় এবং বলদ (আবাল) গরুর সংখ্যা ছিল খুবই কম এবং প্রতিটি আতালে ২/১ টি ছাগল পালন করতেও দেখা গেছে। গরুর উচ্ছেদ্য খাবার ছাগলদের খাওয়ানো হতো। তবে এখানে বলা দরকার অন্যান্য পেশার পাশাপাশি সখের বিষয়টাও কোরবানির গরু লালনপালনে মনে কাজ করতো। জিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে কোরবানির গরু পালনকারীদের মাঝে আনন্দ উৎসব দেখা যেত। গরুর গলায় বাঁধতে দড়ি লাল-সবুজ রঙ করা, রঙ্গিন কাগজের মালা বানানো, একমাত্র নৌপথে ঢাকা নেওয়ার নৌকা ভাড়া করা, গরুর সংখ্যা অনুযায়ী গরু দেখভাল করার লোক ঠিক করা ও ২/৩ দিনের গরুর খাবার, ড্রাম ঠিক করে রাখা। মিরকাদিমের কয়েক হাজার কোরবানির গরুর সাথে মিরকাদিমের অনেক লোক গনি মিয়ার হাটে গরুর বেচাকেনা দেখতে সমাগম হতো। মিরকাদিমের গরু হাটে না উঠা পর্যন্ত গনি মিয়ার হাট জমত না। হাট কর্তৃপক্ষ অপেক্ষায় থাকতো কখন মিরকাদিমের গরু আসবে। মিরকাদিমের গাভীগুলো দেখার জন্য ক্রেতার পাশাপাশি দর্শনার্থীদেরও প্রচুর ভিড় হতো প্রতি বছর কোরবানি ঈদের সময়। কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থের লেখক নাজির হোসেনের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে ঢাকার নবাব আবদুল গনি এখানে একটি হাট বসিয়েছিলেন। সেজন্য হাটটি ‘গনি মিয়া’র হাট নামে পরিচিত হয়েছে। হাটটি প্রতিষ্ঠার পর জনসাধারণকে ঢোল বাজিয়ে এ খবর জানানো হয়। হাটের ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে বলতো : ‘ধার করো, কর্জ করো, গনি মিয়ার হাট কর।’ তবে রহমতগঞ্জের মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে একটানা ৪২ বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পুরনো ঢাকার প্রবীণ ব্যক্তিত্ব হাজী আবদুল আউয়াল। তার মতে, গনি মিয়ার হাটটি প্রতিষ্ঠা করেন জিনজিরার হাফেজ সাহেব। তিনি ছিলেন ঢাকার অন্যতম বিশিষ্ট জমিদার। তার পুরো নাম মৌলভী আহমদ আলী। তিনি চকবাজারে থাকতেন। তিনি যে বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটিই বিখ্যাত মৌলভীবাজার। তবে পরবর্তীতে রহমতগঞ্জ ফুটবল ক্লাব হাটটি ইজারা নিয়ে ক্লাবের জন্য কিছু অর্থ আয় করত। তৎসময় রহমতগঞ্জ ফুটবল ক্লাবের অনেক নামীদামী খেলোয়াড় যারা জাতীয় ফুটবল টীমের খেলোয়াড় কালা, মহসিন, মুছার মতো অনেক তারকাখ্যাতি খেলোয়াড়রা হাঁটে আসতো, তাদের দেখতে অনেক লোক ভিড় করতো। এইদিকে ঈদের ২ দিন আগেই ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মিরকাদিমের ধলেশ্বরী নদীর তীরে বড় বড় নৌকায় গরু উঠানো হত। কোন কোন নৌকায় ৪০ থেকে ৬০টি পর্যন্ত গরু বহন করে ঢাকা নিয়ে যেত। বাড়ি বাড়ি থেকে গরু ঘাটে নেওয়ার সময় বিভিন্ন সাইজের বনাইন্যা গাই দেখতে রাস্তার দুই পাশে এবং নদীর ঘাটে প্রচুর লোকের সমাগম হত। কিছু ত্যাজি গরু ছুটে গিয়ে দৌড়াতে থাকলে আতঙ্কে দর্শনার্থীরা এদিক সেদিক ছুটাছুটি আরম্ভ করতো আর এই হৈ হল্লা ও আনন্দ উৎসবের মধ্যেই একে একে সব গরু নৌকায় তুলে ঢাকার পথে যাত্রা করতো। এই সময় মায়েরা শিশুদের ঘরের বাহিরে আসতে দিত না যদি কোন গরু ছুটে এসে আঘাত করে এই ভয়ে। ঈদের ৩/৪ দিন পূর্বেই গরুর বেপারীরা গণী মিয়ার হাতে লোক পাঠাইত হাটের ভাল জায়গা দখল করে রাখার জন্যে। সেই সময় কিছু ব্যবসায়ী ছিল যারা শতাধিক গরু কোরবানির ঈদে বেচার জন্যে মোটাতাজা (বনাইত) করত। তাদের মধ্যে অন্যতম সাইজদ্দিন হাজী, মিল কালা মিয়া, বাক্কা মিয়া, দুদু মিয়া, দোস্ত মোঃ পোদ্দার, মোহাম্মদ মিয়া, দুদু মোস্তফা, ছলিমুল্লাহ মিয়া প্রমুখ লোকজন। এখন তাদের কেহ জীবিত নাই। আবার অনেককে দেখা যেত মিরকাদিমের আশপাশ এলাকা থেকে গরু কিনে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঢাকা গনি মিয়ার হাটে নিয়ে যেতে।
ঈদের ১০/১৫ দিন পূর্ব থেকেই আশপাশের এলাকার গৃহস্তের ও লোকদের যারা কোরবানীর ঈদে বিক্রির জন্য ২/১ টি গরু লালনপালন করতো তাদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে দালালের মাধ্যমে গরু কিনে নিজেদের গরুর সাথে হাটে নিয়ে যেত। আসলে মিরকাদিমের গরুর একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। যারা কোরবানীর গরু লালনপালন করতো তারা গরুর খাদ্য হিসাবে মইশনা খৈল, মৌশুরির পাউডার, বুটের বা খেসারির ভুষি, ধানের কুঁড়া এবং চাউলের খুদ দিয়ে জাউ রান্না করে খাবার দিত। তাছাড়া দুই তিন বেলা শুকনা খড়ও খেতে দিত। এই মিরকাদিমের গরুর মাংস নরম ও সুস্বাদু হতো। পুরান ঢাকার আদি-ঢাকাবাসীর কোরবানীর গরুর এক নাম্বার চাহিদা ছিল মিরকাদিমের গাই গরু। এখানে উল্লেখ্য যে মিরকাদিমের যারা অধিক সংখ্যায় কোরবানীর গরু লালনপালন করতো তাদের অনেকের কমলাঘাট বন্দরে ভোজ্য তেল ও ডাইলের মিল ও রিকাবীবাজারে রাইস মিল ছিল। তাই তাদের পশু খাদ্যের চাহিদা মিটাতে অসুবিধা হতো না। গরু বিক্রির মধ্যস্থতা করে অনেকে সখের বিষয় গণী মিয়ার হাট মাতিয়ে রাখতো। তাদের মধ্যে ছিল সবুর মিয়া, আবু বকর মৃধা ও আব্বাস মিয়া অন্যতম। তারা সখের বশে গনি মিয়ার হাটে মিরকাদিমের গরু বেচাবিক্রি করত। তাদের সাথে পুরান ঢাকার অনেক লোকজনের সুসম্পর্ক ছিল। তারা পছন্দমতো লোকদের মাধ্যমে কোরবানীর গরু কিনে নিয়ে যেত। অনেকে কোরবানীর গরুর দালালী করে তৎসময় ১০/২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি আয় করতো ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকে দালালরা টাকা পেত। অনেক দালাল বিক্রেতার সাথে গরুর দাম ঠিক করে বেশী দামে বিক্রি করে বাড়তি টাকা নিয়ে নিত। বিকেল ও সন্ধ্যার মধ্যেই মিরকাদিমের গরু গণি মিয়ার হাটে-উঠতে শুরু করে এবং রাতের মধ্যেই অধিকাংশ গরু বিক্রি হয়ে যেত। অনেক ক্রেতা গাড়ী নিয়ে একসাথে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতো এবং আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে কোরবানীর গরু কিনে নিয়ে যেত। কোরবানীর জন্য এককভাবে অনেকে ৪/৫টি পর্যন্ত গরু কিনে নিয়ে যেত। গনি মিয়ার হাটের বাড়তি আকর্ষণ ছিল ৫ টাকা প্লেট তেহারী, বিরিয়ানী, মিরকাদিমের লোকদের কাছে এই তেহারী, বিরিয়ানী ছিল বাড়তি আকর্ষণ। রাতে অনেকে গরুর হাটেই ঘুমাতো, আবার অনেকে রহমতগঞ্জের বাসিন্দা পরিচিতজনের বাসায় রাতে ঘুমাতো। মিরকাদিমের অনেকে রহমতগঞ্জে স্থায়ীভাবে বসবাস করতো। তারা এই গরুর বেপারীদের পূর্ব থেকেই থাকার ব্যবস্থা করে রাখতো। অনেক গরুর ক্রেতা ইজারাদারের টোলের টাকা পরিশোধ করে সেখানেই গরুর টাকা পরিশোধ করে দিত। যারা একাধিক গরু বেশী দামে খরিদ করতো তারা গরুর মালিককে নিজের বাড়ীতে নিয়ে যেত এবং টাকা পরিশোধ করে করে গরুর বেপারীকে হাটে পৌঁছে দিত এবং গরুর মালিককে বিভিন্নভাবে আপ্যায়ন করতো। এই সকল কোরবানির গরু লালনপালনকারীদের মৃত্যুর পর এবং পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা-দিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার এবং ব্যবসার প্রসার ঘটায় নতুন প্রজন্ম এই কোরবানীর গরু লালনপালনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। ঘনবসতিপূর্ণ এই মিরকাদিম এর পরিবারগণের বংশবিস্তার ঘটলে এবং বাসস্থানের অভাব দেখা দেওয়ার তারা গোয়ালঘর বসতস্থান বানিয়ে ফেলে। এখন আর মিরকাদিমে লোকজন কোরবানীর ঈদে বিক্রির জন্য গরু লালনপালন করে না। আশপাশ এলাকার কিছু লোক ২/৪ টি গরু লালনপালন ও খামারের মাধ্যমে গরু পালন করলেও সেই গরু আর রহমতগঞ্জের গণি মিয়ার হাটে নিয়ে যান না। তারা স্থানীয় হাটেই বিক্রি করে দেয়। তাই মিরকাদিমের ঐতিহ্যবাহী কোরবানীর গরু লালনপালন ও পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের গণি মিয়ার হাট-এখন ইতিহাস।