নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় ইছামতি নদীর (ডহরি-তালতলা খাল) তীরবর্তী এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত বাল্কহেড চলাচল, উত্তাল ঢেউ আর প্রবল স্রোতের কারণে ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে নদী তীরবর্তী ঘেঁষা বাজার, মসজিদ-মাদ্রাসা, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আশ্রয়ণ প্রকল্প, আশপাশের গ্রাম ও বসতভিটা। গত ১ সপ্তাহে পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের ১০টি পরিবারের জমি বসত-ঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। উপজেলার নদী তীরবর্তী গ্রামের শত শত পরিবার নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে। জানা যায়, ধলেশ্বরী নদীর তালতলা দিয়ে এই খালটি লৌহজংয়ের ডহরি দিয়ে পদ্মায় গিয়ে মিলিত হয়েছে। ইছামতী নদীর শাখা নদী হিসেবে পরিচিত (ডহরি-তালতলা খাল) ভাঙনে উপজেলার নদীপাড়ের ইউনিয়নগুলোর বেশিরভাগ এলাকা নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে কলমা ও গাঁওদিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের বসত-ঘর, বাজার, মাদ্রাসা, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশ্রয়ণ প্রকল্প। খালের দুইপাড়ে ভাঙন দেখা দেয়ায় পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের অর্ধেক অংশ এখন নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনরোধে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভাঙন আরও বড় আকার ধারণ করার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। তীব্র ভাঙনে বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেলেও জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় সংশ্লিষ্টদের প্রতি হতাশ ও ক্ষুব্ধ এলাকার ভাঙন কবলিতরা। গ্রামবাসী জানায়, অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচলকারী বালুর বাল্কহেড বন্ধের পাশাপাশি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা না হলে তীরবর্তী গ্রামগুলো বিলীন হয়ে যাবে। এমনিতেই করোনা আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছে মানুষ। এর মধ্যে নদী ভাঙ্গন নামের আরেক আতঙ্ক যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় নদীর পাড়ের খেটে খাওয়া মানুষের ঘুম নেই চোখে। পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আল-আমিন (অরুন ফকির) জানান, কয়েক বছর ধরে এখানে নদীভাঙন চলছে। এই নদীতে তাদের ৪ একর জমি বিলীন হয়েছে। তাদের অবশিষ্ট বসতবাড়ীতেও ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্থায়ী বাঁধের ব্যবস্থা না নিলে তাদের বসতভিটার শেষ অংশটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তিনি আরও জানান, এ গ্রামটির চারভাগের তিনভাগ অংশ ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। তার বাড়ির নদীর অপরপ্রান্তে অল্প কয়দিন আগে হাড়িদিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পটির বাউন্ডারিতে ভাঙন দেখা দিলে সাথে সাথে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধ করা হয় এবং শামুরবাড়ী ও ডহরির কিছু অংশে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও এই সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে। তিনি সরকার, স্থানীয় সংসদ ও সংশ্লিষ্টদের নিকট তাদের ভিটাবাড়ির শেষ অংশ ও গ্রামটিকে রক্ষার জন্য এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। নদীর তীরের বাসিন্দা সেলিম মোল্লা জানান, তার বাড়িটি সাড়ে তিন শতাংশ জমির ছিলো। নদীতে তার আড়াই শতাংশ বসতবাড়ী বিলীন হয়ে গেছে। এখন এক শতাংশের মত আছে। তার দুইটি ঘরে তাদের সাতজন সদস্য বসবাস করে। তিনি এই নদীতে মাঝির কাজ করেন। বাল্কহেডের ঢেউয়ে প্রতিদিনই তার বসতভিটা ভাঙছে। পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের নদীর তীরের বাসিন্দা জসীম মোল্লা জানান, এই নদী ভাঙনে তিনি বাড়ির ২০ শতাংশ জমি হারিয়েছেন। প্রতিবছর তার ২ শতাংশের মত জমি এই নদীতে ভাঙছে। বর্তমানে মাথা গোঁজার শেষ অংশ জমিটিও রয়েছে ভাঙনের মুখে। এটি বিলীন হয়ে গেলে পরিবার-সন্তানদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হবে তাকে। তিনি আরও জানান, বর্ষায় নদীতে প্রচুর স্রোত থাকে। এ মৌসুমে বালুর বাল্কহেড এই নদী দিয়ে বেপরোয়া চলাচলের কারণে নদী ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বাল্কহেড যখন যায় তখন প্রচুর ঢেউ ও স্রোত সৃষ্টি হয়। তখন নিচ থেকে মাটি সরে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা না নিলে তার সর্বশেষ অবশিষ্ট বসতবাড়ী নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে বলে তিনি জানান। পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের আরেক বাসিন্দা শহিদুল্লাহ জানান, গত দুইদিন আগে আমাদের একটি ঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। বাকি অর্ধেক বাড়ি নদীতে গিলতে বসেছে সেই চিন্তায় পরিবারের লোকজন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে ভাঙন আতঙ্কে। অব্যাহত নদী ভাঙনে ভিটে-মাটি, গাছপালা ও ফসলি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে এ এলাকার মানুষ। স্থানীয় কলমা ইউপি সদস্য ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার ও নওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. রুহুল আমিন বেপারী জানান, ডহরির উত্তর পাশ থেকে পশ্চিম নওপাড়া গুদারঘাট পর্যন্ত প্রতি বছর কমবেশি নদীতে ভাঙছে। তবে পশ্চিম নওপাড়া গ্রামটি বেশি ভাঙছে। ইতিমধ্যে অনেক বাড়ি-ঘর স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। যাদের পেছনে জমি আছে তারা ঘরগুলো সরিয়ে সাইডে নিচ্ছে। যাদের জমি নেই তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। দ্রুত ভাঙন ঠেকাতে না পারলে এ গ্রামটির বাড়িঘর, স্থাপনা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। হাড়িদিয়া গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম শিকদার জানান, বর্ষায় নদীর তীব্র স্রোত ও নিয়ন্ত্রণহীন বাল্কহেড চলাচলের কারণে তার ভিটাবাড়ির অর্ধেক অংশ বিলীন হয়ে গেছে। বাকি অংশটিও নদীতে গিলে খাচ্ছে। তার বাড়ির পাশের বড়মোকাম বাজার ও মসজিদটি এখন নদীর মুখে রয়েছে। তিনি আরও জানান, হাড়িদিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পটির পাশে নদীর পাড় ঘেঁষে বাল্কহেড থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বালু আনলোড করে বালু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মহল। তাই নদীর পাড় ঘেঁষে সারিবদ্ধ করে রাখা হয় বালিভর্তি একাধিক বাল্কহেড। এতে নদীর তীরে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয় আর এই স্রোতের কারণে নদীর পাড় ভাঙন দেখা দিয়েছে। তিনি একাধিকবার বালুর বস্তা দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করলেও বাল্কহেডের ধাক্কায় বস্তা সরে যায়। এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করায় ড্রেজার ব্যবসায়ী চক্রের দ্বারা একাধিকবার হুমকির ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে নজরুল ইসলাম শিকদার জানান। কলমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব শেখ জানান, ইছামতি (ডহরি-তালতলা) নদীর ভাঙনে পশ্চিম নওপাড়া গ্রামটি ক্ষতিগ্রস্ত। ভাঙন রোধে সরকারের কাছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাবর আবেদন করছি অথচ কোন কাজই করছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড। আপাতত এখানে অস্থায়ী বাঁধ দিতে না পারলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে গ্রামটির। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঢাকা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, মুন্সীগঞ্জে বিভিন্ন জায়গায় নদীর পাড় কমবেশি ভাঙন রয়েছে। সবগুলো জায়গায় ভাঙন রোধ সম্ভব নয়। তবে ইতিমধ্যে বেশকিছু জায়গায় ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে যেমন- স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির বাজার সেখানে জরুরী ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এদিকে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল আওয়াল জানান, আমি অল্প কিছুদিন হয় লৌহজংয়ে এসেছি। এ ভাঙনের বিষয়ে আমার জানা ছিলনা। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।