স্থাপনাটিকে ঘিরে বেড়েছে এলাকার সৌন্দর্য ; খাবারের দাম নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
পদ্মাপাড়ের জেলা মুন্সীগঞ্জের মাওয়া শিমুলিয়া ঘাটে ইলিশের স্বাদ উপভোগে ভোজনরসিকদের ভিড় হরহামেশা লেগেই থাকে। এবার সেই ঘাটের অদূরে ‘প্রজেক্ট হিলসা’ নামে নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম ইলিশ মাছের আদলে রেস্টুরেন্ট। নান্দনিক স্থাপনাটিকে ঘিরে বেড়েছে এলাকার সৌন্দর্য। নতুন এ আয়োজন দেখতে রাজধানী ঢাকাসহ দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে আসছে হাজারও মানুষ। সরেজমিনে দেখা যায়, লৌহজং-শিমুলিয়া ঘাটের অভিমুখে সবুজ দিগন্তের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র অবকাঠামোর রেস্টুরেন্টটি। দেখলে আকৃতি অনুমানে ভুল হবে না কারোই। জাতীয় মাছ ইলিশের আদলে আধুনিক ধাঁচের এ স্থাপনা। ইলিশের মতো সরু মাথা আর লেজ। মূল দেয়ালেও ইলিশের রূপালি আঁশের আদলে স্বচ্ছ কাচের সংযোজন। হরেক রকম ইলিশের রেসিপিসহ মিলবে বিভিন্ন দেশের খাবার। দাম কিছুটা বেশি হলেও ব্যতিক্রমধর্মী এ উদ্যোগ দেখতে আর পদ্মার তাজা ইলিশের স্বাদ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষের আগমনে তৈরি হচ্ছে মিলনমেলা। শুধু দিনে নয়, রাতের আঁধারে আলোকসজ্জায় বেড়ে যায় রেস্টুরেন্টটির সৌন্দর্য। কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৪০ হাজার বর্গফুট জায়গায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এটি। দুই শতাধিক গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। মতিন নামে এক ভোজনরসিক বলেন, ‘ফেসবুকে ছবি দেখে এসেছি। আসলেই স্থাপনার পাশাপাশি পরিবেশ খুব সুন্দর। রাতে সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। রাত পর্যন্ত থেকে দেখে যাব। এটি তৈরির পর স্থানীয়দের কাছেও বিনোদনের নতুন ক্ষেত্রের রূপ লাভ করেছে। দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীর পাশাপাশি খুশি স্থানীয়রাও। এমন ব্যতিক্রমী উদ্ভাবনী চিন্তা করেছেন রেস্তোরাঁর মালিক এবা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক বিশিষ্ট শিল্পপতি শিপন মৃধা। তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পদ্মার ইলিশের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে ভবিষ্যতে পদ্মা সেতু তৈরি হলে এ এলাকাটি পর্যটন এলাকায় রূপ নেবে এমন চিন্তা থেকেই ভোজনশালাটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানান কর্তৃপক্ষ। প্রজেক্ট হিলসার ম্যানেজার নিশাত আহমেদ বলেন, পদ্মার ইলিশের খ্যাতি সব জায়গায় রয়েছে। ইলিশের সঙ্গে মিল রেখেই এ স্থাপনাটি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু সার্ভিস দিতে পারছি এরই মধ্যে অনেকটা সাড়া ফেলেছে। দর্শনার্থীদের রিভিউর দিক থেকে দেশের প্রথম সারিতেই চলে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এখানে থাই, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান কন্টিনেন্টাল সি ফুড এবং অবশ্যই ইলিশের হরেক রকমের আইটেম রাখা হয়েছে। যেখানে ভর্তা, ভাজি, ইলিশের পাতুরিসহ নানা রেসিপি থাকছে। কিছু স্পেশাল ডেজার্ট রয়েছে, যা হয়তো অনেক ভালো রেস্তোরাঁয়ও পাওয়া যায় না। মিষ্টির আইটেম আছে। বেশকিছু জুসও আছে, যা অন্যদের চেয়ে আলাদা। আকৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের মালিকপক্ষের মাথায় হঠাৎ করে এ চিন্তাটি এসেছে। পদ্মাপাড়ে মানুষ ইলিশ খেতে আসে তার সঙ্গে মিল রেখেই ভবনটির ডিজাইন করা হয়েছে। এছাড়া এখানে পদ্মা সেতু চালু হলে এ এলাকাটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে রূপ নেবে, সে চিন্তা থেকেও রেস্তোরাঁটি তৈরি করা হয়। নিশাত আহমেদ আরও বলেন, এখানে ইলিশের দাম বাজারের সঙ্গে মিল রেখে কমানো বাড়ানো হয়। এছাড়া খাবারের সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ১৫ শতাংশ ভ্যাট রাখা হয়। পাশাপাশি ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ। তবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য কোন চার্জ নেওয়া হয়না। এই ব্যতিক্রমী স্থাপনার কারণে অল্পদিনেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সাড়া ফেলেছে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটের অদূরে নবনির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় রেস্তোরাঁ ‘প্রজেক্ট হিলসা’। অনেকেই ছবি-ভিডিও দেখে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে যাচ্ছেন ইলিশ মাছের আদলে তৈরি রেস্তোরাঁটিতে। তবে সেখানে খাবারের দাম নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ। খাবার বিলের সঙ্গে সরকারি করের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি যুক্ত করছে সার্ভিস চার্জ বাবদ আরও ১০ শতাংশ টাকা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা। এসব অভিযোগ ছাড়াও অর্ডারের পর খাবার পরিবেশনে বিলম্ব এবং মূল আকর্ষণ ইলিশ মাছের মান নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে রেস্তোরাঁর পরিবেশ আর মানের তুলনায় দাম তেমন নয় বলছে কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৪০ হাজার বর্গফুট আয়তনের রেস্তোরাঁটিতে ইলিশ মাছের ২৪ ধরনের রেসিপিসহ মোট ৩শ ধরনের খাবার পাওয়া যায়। তবে প্রতিটি খাবারের দামই আশপাশের অন্যান্য রেস্তোরাঁ থেকে দ্বিগুণ বা এর থেকেও বেশি নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ভোক্তারা। ক্রেতারা বলছেন, খাবারে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ছাড়াও যুক্ত করা হয়েছে ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ। সবমিলিয়ে ২৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ ধরা হচ্ছে। অর্থাৎ চার হাজার টাকার খাবার খেলে মোট বিল গুনতে হবে পাঁচ হাজার আর ১০ হাজার টাকায় বিল হবে ১২ হাজার টাকা। রেস্তোরাঁটিতে আগত একজন অতিথির বিল কপি থেকে দেখা যায়, প্রতি পিস বেগুনভাজার দাম রাখা হয়েছে ৫০ টাকা। যেখানে একইমানের বেগুনভাজা শিমুলিয়া ঘাটের অন্যান্য রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায় ১৫-২০ টাকায়। প্রতি বাটি ডালের দাম ধরা হয়েছে ১০০ টাকা। অন্য রেস্তোরাঁয় ডাল পাওয়া যায় ৫০-৭০ টাকা বাটি। আর প্রতি পিস ইলিশ মাছের দাম নেয়া হয়েছে ১৮০০ টাকা। যেখানে অন্য রেস্তোরাঁয় এক কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের প্রতি পিস ইলিশের দাম নেয়া হয় ১২০০-১৪০০ টাকা। ওই ভোক্তার বিলের কপিতে দেখা যায়, তিনি বেগুনভাজির অর্ডার দিয়েছেন ৪১টি, ইলিশ ১৩টি, ডাল ২০ বাটি এবং ভাত ৪১ প্লেট। সব মিলিয়ে তার খাবার বিল হয়েছে ৩২ হাজার ৬২৫ টাকা। এরসঙ্গে সার্ভিস চার্জ গুনতে হয় তিন হাজার ২৬২ টাকা। আর ভ্যাট পাঁচ হাজার ২২২ টাকা মিলিয়ে বিল দাঁড়ায় ৪১ হাজার ১০৯ টাকা। ‘ফুডব্যাংক মুন্সীগঞ্জ’ নামের একটি খাবার বিষয়ক ফেসবুক গ্রুপে রেস্তোরাঁটি নিয়ে একজনের করা পোস্টে আদনান আকিব নামের এক গ্রাহক মন্তব্য করেছেন, প্রজেক্ট হিলসায় ২০০ টাকার সালাদ খেয়ে প্রায় এক সপ্তাহ ঘুম আসেনি আমার। অন্যদিকে লৌহজং উপজেলার কর্মরত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন ওরা কসাই এখানে খেতে গেলে অনেক টাকা পয়সা রাখে। ফরহাদ নামের একজন বলেন, গত শুক্রবার গিয়েছিলাম। খাবার অর্ডারের পর কয়েক ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে। উন্নত রেস্তোরাঁর এ কেমন অবস্থা? ফরহাদ জানান, অন্যান্য জায়গায় যে খাবার ৪০০ টাকা, একই খাবার এখানে ৮০০ টাকা লাগে। গজারিয়া উপজেলার টেঙ্গারচর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইছহাক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, আমরা শিমুলিয়া ঘাটে পদ্মার পাড়ে ইলিশ খেলাম হিলসায়। ৫ জনে খেয়ে বিল দিয়েছি ২২ হাজার টাকা। সম্প্রতি সরেজমিনে রেস্তোরাঁটি পরিদর্শনে যান মুন্সীগঞ্জের প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আরিফুল ইসলাম। তিনি রেস্তোরাঁটির খাবারের দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যে মানের রেস্তোরাঁর কথা বলা হয়েছে সে মানের রেস্তোরাঁ না এটা। তবে প্রাকৃতিক সোন্দর্যের কারনে এখানে এসে মানুষ খেতে আসে কিন্তু দাম এবং সার্ভিস চার্জে দিশেহারা। আর সবচেয়ে বড় কথা দেশে যেভাবে করোনা সংক্রমণ বিস্তার হচ্ছে সেখানে সামাজিক দূরত্বের কোন বালাই নেই। অনেকে খাবার খেতে এসে ভিড়ের কবলে পড়ে অনত্র খাবার খেতে হচ্ছে। খাবার খেতে ২ ঘন্টা বসে থাকতে হয়। রেস্তোরাঁর কর্তৃপক্ষ জানায়, ৩টা বাজলেই দুপুরের খাবার শেষ ডিনার খাওয়া যাবে। তারা দুপুর ১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা রাখে। অভিযোগ করে করে বলেন, বেগুনভাজি পিস ৪০-৫০ টাকা, ডাল মানভেদে প্রতি বাটি ১০০-২০০ টাকা, আস্ত ইলিশ ১৫০০-২০০০ টাকা, সাদা ভাত ১০০ ও খিচুড়ি ২০০ টাকা (প্রতি প্লেট) করে নেয়া হচ্ছে। আরেক গ্রাহক রাসেল মাহমুদ রসিকতা করে জানান, এখানে খাবারের দাম আর মান তুঙ্গে। এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আসিফ আল আজাদ বলেন, তাদের খাবারের যে দাম সেটা অবশ্যই মেন্যুকার্ডে উল্লেখ করে রাখতে হবে। ভোক্তারা এটি দেখেই খাবেন। ভোক্তারা যদি মনে করেন, এখানে দাম বেশি তাহলে তিনি ওখানে না-ও খেতে পারেন। খাবার দাম মেন্যুকার্ডে যা লিখে রাখা হবে তার থেকে বেশি নেয়া হলে সেটি অপরাধ হবে। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। সার্ভিস চার্জের বিষয়ে তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ সার্ভিস চার্জ রাখা যাবে কি যাবে না, সে সম্পর্কে কিছু বলা নেই। তবে সার্ভিস চার্জের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে ঘোষণা দিতে হবে। মেন্যুকার্ডে লিখে রাখতে হবে। কাস্টমারকে জানিয়ে রাখতে হবে যে, ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ রাখা হবে। এটি না করে থাকলে সেটি অপরাধ হবে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রজেক্ট হিলসা’র ম্যানেজার নিশাত আহমেদ বলেন, দাম বেশি কি-না আমি বলব না, তবে এইরকম একটি পরিবেশে যে ইনভেস্টমেন্ট প্লাস ওভারঅল যা কিছু আছে সেক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন থাকবে আসলেই বেশি রাখা হয়েছে কি-না? আমাদের কাছে দাম অত বেশি মনে হচ্ছে না। তারপরও সামনে কিছু পণ্যের দাম বাড়তে পারে, কিছুর দাম কমতে পারে। তাছাড়া এখানে শিশুদের জন্য রয়েছে খেলাধূলার ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে সুন্দর পরিবেশ। এটি পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ কেটে নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পার্কিং চার্জ, ইলেক্ট্রিসিটি, এসি সবকিছুর ওপর একটি চার্জ হয়। এটি বড় বড় রেস্তোরাঁতেও ধার্য করা হয়। এটি মেন্যুকার্ডে উল্লেখ করা আছে। আবার আমরা অনেক অতিথির কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ নেইনি ; এ কথা কেউ বলে না।
শিমুলিয়ায় ইলিশ মাছের আদলে রেস্টুরেন্ট ‘প্রজেক্ট হিলসা’
আগের পোস্ট