মুজিব রহমান
প্রগতিশীলতার আন্দোলনের আরেকটি কালো দিন ২০১৮ সালের ১১ জুন। এদিন সন্ধ্যায় প্রকাশক, প্রগতিশীল লেখক, সাংবাদিক ও মুন্সীগঞ্জ জেলা সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কমরেড শাহজাহান বাচ্চু ভাইকে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী হত্যা করে। তিনি তার গ্রাম বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জের কাকালদিতে এক ওষুধের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এমন সময় দুটি মোটরসাইকেলে করে চারজন উগ্রপন্থী এসে তার বুকে গুলি করে। আতঙ্ক তৈরির জন্য দুটি ককটেল ফাটিয়ে মোটরসাইকেলে করেই পালিয়ে যায় কাপুরুষের মতো। খুনিরা ছিল শ্মশ্রুমন্ডিত। পরদিন ঘটনাস্থলের নিকটে দুটি রামদা পাওয়া যায়। উগ্রপন্থীরা ২০০৪ সালে প্রথমে অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদকে হত্যার জন্য চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে এবং রাজশাহীতে অধ্যাপক ইউনুসকে হত্যা করে। এর প্রায় ৯ বছর পরে ২০১৩ সালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরুর পরে পল্লবীতে বাসার কাছে থাবা বাবা খ্যাত ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মৌলবাদীদের জিঘাংসার শিকার হন একের পর এক প্রগতিশীল ব্লগার, লেখক, প্রকাশক। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এক বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিপুলসংখ্যক মেধাবী তরুণ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ২০১৩ সালে উগ্রপন্থী জেএমবি প্রগতিশীল মানুষকে হত্যার জন্য একটি হিটলিস্ট করেছিল। সেই লিস্টে ছিল শাহাজাহন বাচ্চুর নাম। গত ২৪ জুন গাজীপুর থেকে তাকে হত্যার জন্য এক জেএমবি জঙ্গিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ওই জঙ্গির বাড়ি পঞ্চগড়। শাহজাহান বাচ্চু পঞ্চগড়ে বসতবাড়ি করে কিছুকাল বসবাস করেছেন। ওখানে তিনি শুদ্ধচর্চা কেন্দ্র এবং হুমায়ুন আজাদ পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন। বাচ্চু ভাইকে হত্যায় অংশ নেয়া চারজনের মধ্যে তিনজনই পুলিশের ক্রস ফায়ারে খুন হয়েছে। এছাড়া জড়িত আরো দুজনও ক্রস ফায়ারে খুন হয়েছে। সরাসরি খুনে অংশ নেয়া একজনকে এখনো চিহ্নিত করা যায়নি।
শাহজাহান বাচ্চুর জন্ম ১৯৫৮ সালে কাকালদি গ্রামে। তার পিতা মমতাজ উদ্দিন মধ্যপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। এরপর বিক্রমপুরের হাজারো তরুণের মতো জাপান প্রবাসী হন। জাপানে অবসানকালেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শুধুমাত্র কবিতার বই প্রকাশের জন্য বিশাকা প্রকাশনী। কন্যা বিপাশা, নিজে শাহজাহান বাচ্চু ও স্ত্রী কানন এর নামের অদ্যাক্ষর নিয়ে বিশাকা প্রকাশনী। এই প্রকাশনী থেকে তিনি ৬ শতাধিক কবিতার বই প্রকাশ করেন। অন্তত একশত জন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেন। নিজের প্রথম ছড়ার বই ‘রঙ ঢঙ তামাশা’ও বিশাকা প্রকাশনী থেকেই প্রকাশ করেন। বইটিতে সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন। ২০১৩ সালে উগ্রপন্থীদের হাতে খুনের উৎসব শুরু হলে তিনি ব্যবসা গুটিয়ে নেন। এ সময় তিনি মুন্সীগঞ্জ জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক হন। অনবরত খুনের হুমকিতে থাকার কারণে তিনি রাজনীতিতেও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তিনি ফেসবুক ও ব্লগে লেখালেখি করতেন। তিনি তার ফেসবুক আইডিতে প্রোফাইল পিকচার হিসাবে দোয়েল পাখি ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন আড্ডায়, সভায়, সমাবেশে বলতেন, একটি দোয়েল শিস দিয়ে যায়, বিন্দু থেকে বৃত্তকে কাঁপায়। তিনি কারণে অকারণে ছুতানাতায় এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ফলে এলাকায় তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় ও বন্ধুবৎসল ছিলেন। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তুলে তিনি বিন্দু থেকে বৃত্তকে কাঁপাতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সারাদেশের প্রত্যেকটি গ্রাম থেকে কেউ না কেউ মুক্ত চিন্তার শিস দিয়ে যাবে এবং সেই বিন্দুই কাঁপিয়ে দিবে সারা দেশকে।
তিনি লেখক শিবিরের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। সাপ্তাহিক সেবা পত্রিকা দিয়েই নেন সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। এরপর নিজেই দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেন মাসিক আমাদের বিক্রমপুর পত্রিকাটি। তিনি ১৯৮৪ সালে বিক্রমপুর প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। ছিলেন অন্যতম সহ-সভাপতি। প্রগতিশীল প্রতিটি আন্দোলনে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। গণজাগরণ মঞ্চে যেমন সক্রিয় থেকেছেন তেমনি তেল, গ্যাস রক্ষা আন্দোলনেও জড়িয়েছিলেন। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনেও সাড়া দিয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার নেতৃত্ব নিয়ে সদলবলে লংমার্চে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাচ্চু ভাই শ্রীনগরে শেষবার আসলেন ২০১৮ সালের রমজানের আগে আমাদের একটি পাঠচক্রে। সাথে ছিলেন সৈয়দ জামাল ও রোজি আক্তার। রমজানে একদিন সকাল ১০টার দিকে আমার অফিসে আসলেন। ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথা হয়। দুপুরে লাঞ্চ করেন। থাকলেন বিকেল পর্যন্ত। দুদিনই তাকে মৌলবাদীদের হুমকির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। তার ফোনে প্রায়শই হুমকি আসতো। এক হুমকির কথা জানালেন। বিক্রমপুরে নিজবাড়ি কাকালদিতে তিনি ঘরে রাতে শুয়েছিলেন। তবে এটা বুঝা গিয়েছিল, খুনিরা তার খবরাখবর সবসময়ই রাখতো। তিনিও আড্ডা একেবারেই কমিয়ে দিয়েছিলেন। কালেভদ্রে ইছাপুরা বাজারে এক ঘনিষ্ঠজনের মিষ্টির দোকানে আসতেন নয়তো ওই ওষুধের ফার্মেসীতে। ঢাকাতেই বেশি থাকতেন এবং গৃহবন্দী। ফলে তিনিও মনে করেছিলেন, জঙ্গিরা তাকে ধরতে পারবে না। তাই ওই পাঠচক্র শেষে কবি সান্দ্র মোহন্তকে বললেন, সান্দ্র আমি সতর্ক আছি। তুমি সাবধানে থেকো। জঙ্গলরাজ্যে বাস করলে শ্বাপদকূল থেকে সাবধানে থাকতেই হবে। সবাইতো সাবধানে থাকে। কিন্তু যাকে নিয়ে এতো কথা তিনিও সাবধানেই থাকতেন। বিক্রমপুরের প্রখ্যাত লেখক, ভাষাবিদ ড. হুমায়ুন আজাদও বলতেন, আমাকে কিছু করার সাহস মৌলবাদীরা পাবে না। তোমরা সাবধানে থেকো। তারা প্রাণ দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন, এদেশে সাবধানে থাকার কিছু নেই। সাবধানে থাকার কোন জায়গাও নেই। তাই বাঁচতে হলে অন্ধকারের অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লড়াই করেই বাঁচতে হবে।
শাহজাহান বাচ্চু সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের আজন্ম কর্মী মনে করতেন নিজেকে। সেই সংগ্রামে তিনি আজ মৃত্যুঞ্জয়। যারা তাকে হত্যা করে মুক্তচিন্তার বিনাশ করতে চেয়েছিল তারাও দেখবে শাহজাহান বাচ্চু মৃত্যুঞ্জয়।