নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের আড়িয়ল বিল, সিরাজদিখান ও লৌহজং এই তিন উপজেলার শহরগুলোতে শত বছর যাবৎ ঐতিহ্যবাহী সরকারি খাল দিয়ে হরহামেশা চলাচল করে আসছিল ছোট বড় মাঝারি নৌকা। এ জেলায় বছরের তিন মাস বর্ষা মৌসুমে রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় একমাত্র ভরসা ছিল নৌকায় পারাপার। তাও গত ২ বছর আগেও ঐতিহ্যবাহী শ্রীনগর সরকারী খাল দিয়ে। আজ প্রভাবশালী মহলের দখল আর দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে এ খালটি। একের পর এক দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার কারণে খালের দু’পাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ দোকানপাট ও স্থাপনা। ফলে দিন দিন খালটি সরু হয়ে যাচ্ছে। বিক্রমপুরের গুরুত্বপূর্ণ শ্রীনগর বাজার ও বাড়ৈখালী বাজারের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ময়লা আর্বজনা অপসারণ করা হচ্ছে বছর জুড়েই। যার ফলে খালটি পরিণত হয়ে উঠেছে বর্তমানে ময়লার ভাগাড়ে। এতে করে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। নাকে কাপড় না দিয়ে চলাচল দুষ্কর এই পথের চলাচলকারী ছাত্র-ছাত্রী পথচারীদের। মারাত্মকভাবে দূষণ হচ্ছে পরিবেশ। বিষয়টি কয়েক দফা প্রশাসনকে জানানোর পরেও নজরে আসেনি বা আমলে নেননি। বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী আড়িয়ল বিল, বাড়ৈখালী-শেখর নগর, লৌহজংয়ে বয়ে যাওয়া খালটির এক সময়ের যৌবনের সেই স্রোত এখন আর দেখা যায় না।
লৌহজংয়ে যাতায়াতের এই ক্ষতি স্থানীয়দের কাছে এখন খুবই পরিচিত । পাঁচ বছর আগেও এ খালটি ছিল নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার উপযোগী। প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের দখলদারি আর অবহেলায় একসময়ের টইটুম্বুর খাল এখন পরিণত হয়েছে দুর্গন্ধময় এক নালায়। পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এই খালগুলোর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। দখলদারদের দখলদারি আর অবহেলায় এখন তা প্রায় বিলুপ্তির পথে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঐতিহ্যবাহী শ্রীনগর বাজার এবং বাড়ৈখালী বাজারের সাথে মিশে থাকা এই খালটি মূলত পদ্মা নদীর শাখা নদী। ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে মিশেছে। খালের দু’পাশ দখল করে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের স্থাপনা। এছাড়া দীর্ঘদিন খালটিতে ড্রেজিং ব্যবস্থা না করার কারণে পলি মাটি ও ময়লা-আর্বজনা ফেলায় খালটির হারিয়ে যেতে বসেছে তার ঐতিহ্য।
শ্রীনগর বাজারের বিভিন্ন পঁচা সবজি, মরা হাঁস-মুরগী ও গরু-ছাগলের রক্তসহ নানা ধরনের ময়লা ফেলার কারণে দূর্গন্ধে সাধারণ মানুষের চলাচল খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে। খালের মধ্যে আবর্জনা দেখে মনে হবে এটা কোনো ময়লার ডাস্টবিন।
শ্রীনগর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, বছরের পর বছর এ খালে ড্রেজিং না করায় নাব্য সংকটের কবলে খালটি, তাতে হারিয়ে গেছে মূল সীমানা। খাল পার হওয়ার সময় দূর্গন্ধে তাদের বমি চলে আসে। শ্রীনগর বেজগাঁওয়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ ওসমান মাহমুদ জানান, আমরা এই খালের পানি খাওয়াসহ ব্যবহার করে আসছি ছোটবেলা থেকে, এখন তা শুধুই স্মৃতি। এখন খালের পানি ব্যবহার তো দূরের কথা। খালের পানি এখন কালো ও দূর্গন্ধের কারণে পাশ দিয়ে যাওয়াই দুষ্কর। একসময় এই খালে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেতো। অনেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। খাল দিয়ে পণ্যবাহী লঞ্চ, স্টিমার, নৌকা চলাচল করতো। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষ অতি সহজেই তাদের পণ্যবাহী মালামাল অনায়াসে নিতে পারতেন। কিন্ত অত্যন্ত দুঃখের বিষয় দখল আর দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী শ্রীনগর খালটি। হয়তো এভাবে দখল বাণিজ্য চলতে থাকলে একসময় খালটি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর-সিরাজদিখান উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।
মোঃ মোতালেব হোসেন জানান, খালের দু’পাশে সরকারি দুটি ব্রিজ রয়েছে যার শুভ উদ্বোধন আজ ২২ মাস। কিন্তু অবৈধ দোকানঘর উত্তোলনের কারণে ব্রীজ দুটিও কোন কাজে আসছে না পথচারীদের। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট ঠেলে চলাচল করতে হয়। তাতে প্রায়ই ঘটছে দূর্ঘটনা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা বিভাগ) রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, মুন্সীগঞ্জের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাল খননের ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। এর মধ্যে শ্রীনগর বাজার খালটিও রয়েছে। তবে বড় সমস্যা হচ্ছে দু’পাশের দখল, খালের উৎসমুখ ও যে পথ দিয়ে পানি অপসারণ হবে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো অপসারণ না করে মধ্যভাগে খাল খনন করা হলে পানির প্রবাহ আসবে না। এতে খনন কোন কাজেই আসবে না। জেলা প্রশাসন থেকে খালের সীমানা নির্ধারণ, উৎসমুখ খনন করে দেওয়া হলেই খনন কাজ শুরু করা যাবে।
এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল বলেন, দেশের ছোট-বড় প্রতিটি খাল উদ্ধার ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সরকার কাজ করে চলেছে। খালটির বিষয়ে জানা ছিল না। খালটির বিষয়ে আগে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা খোঁজ নিবো। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে খাল উদ্ধার, সীমানা নির্ধারণ, খননসহ সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।