নিজস্ব প্রতিবেদক
স্ত্রী বাঁচাতে পারেনি স্বামীকে, সন্তান বাঁচাতে পারেনি বাবাকে। টাকার লেনদেন নিয়ে ঝগড়া এক পর্যায় ছোট ভাই বড় ভাইকে শ^াসরোধ করে হত্যা করেছে। তড়িঘড়ি লাশ দাফন, থানায় মামলা নেয়নি পুলিশ, এমন অভিযোগ স্ত্রী-সন্তানদের। অসহায় পরিবারটি দ্বারে দ্বারে ঘুরে কূল কিনারা না পেয়ে ঘটনার ২৩ দিন পর আদালতে গিয়ে মামলা করেছে। হৃদয় বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার কেয়াইন ইউনিয়নের বড়বর্তা গ্রামে। গত ২০ জুলাই অন্ধকার হয়নি, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা হবে। বাড়ির পাশে ৫০ গজের মধ্যে মন্টু মিয়ার চায়ের দোকান। বড়বর্তা গ্রামের ছেলে রজ্জব আলী, বয়স ৪৬। আপন ছোট ভাই আইউব আলীর (৩৫) সাথে মাহিন্দ্রা ট্রাকটরের ভাড়ার টাকা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। সে সময় তাদের সবার বড় ভাই আব্দুল আলী (৫৮) সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এবং রজ্জব আলীর সাথে রাগারাগি করছিল। এক পর্যায় ছোট ভাই আইউব আলী তার বাহু দিয়ে রজ্জব আলীর গলা চেপে ধরে। রজ্জব আলীর শ^াসরোধ হয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। ঢাকায় হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। রজ্জব আলীর মেয়ে রজনী (১৮) জানান, তার বাবার সাথে চাচার বেশ কিছুদিন ধরে ঝগড়া হচ্ছিল। আইউব আলী চাচাকে একটা মাহেন্দ্র গাড়ি খালুর কাছ থেকে ভাড়ায় এনে দিয়েছিল আমার বাবা। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে আমি গেটের সামনে যাই। বাবা ও চাচা রাগারাগি করছে। এ সময় চাচা বলে আমি আজ তোকে মেরে আমিও মরে যাবো। এ সময় আমি দৌড়ে যাই। আমি যাইতে যাইতে চাচা আমার বাবার গলায় এক হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখছে। এতো জোরে ধরেছে বাবা নড়তেও পারেনাই কিছু বলতেও পারেনাই। আমি কান্নাকাটি করে চাচাকে বলি বাবাকে ছেড়ে দেন। তাও ছাড়েনাই। চাচার বুকে শার্টের মধ্যে একটা সানগ্লাস ছিলো সেটা ভেঙ্গে বাবার গালে ঢুকে যায়, অনেক রক্ত বের হয়। অনেকক্ষণ পর ছেড়ে দেয়। তখন বাবা ৩টা জোরে জোরে নিঃশ^াস নিয়া মাটিতে পড়ে যায়। এরপর আরেক চাচার গাড়ি দিয়া ডাক্তারের কাছে নিলে মৃত ঘোষণা করে। নিহত রজ্জবের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৪১) জানান, আমার ভাশুর আব্দুল আলীর নির্দেশে, দেবর আইউব আলী আমার স্বামীকে মেরেছে। ঐ দিন সন্ধ্যায় চিল্লাচিল্লি শুইন্না আমি যাইয়া দেখি আমার স্বামীকে আইউব আলী গলায় চিপ দিয়া ধরছে। আমি ধরতে গেলে আব্দুল আমাকে জোরে ধাক্কা দিয়া ফালায় দেয়। আমার স্বামীকে চিপ ছাড়লে নিচে পড়ে যায়। আমি তাকে নিয়া হাসপাতালে যাই, ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে। রাতে আমি লাশ নিয়া বাড়ি আসি। পরদিন সকাল ৮টায় তারা আমার স্বামীকে গোসল করাইয়া তড়িঘড়ি করে জানাযা দেয়। আমার জ্ঞান ফিরলে আমি বলি তারা আমার স্বামীকে মারছে। আমি চেয়ারম্যান মেম্বারদের ও স্বজনদের জানাই। এরপর থানায় যাই পুলিশ বলে লাশ দাফন হইছে, মামলা নেওয়া যাবে না, পরে আদালতে যেতে বলে। এরপর ৫ দিনের দিন ৩ চেয়ারম্যান নিয়া বসেছিল মীমাংসা করতে। আসামী দুইজন কোন বিচার মানেনাই। আমি অনেকের কাছে যাই কোন কূল কিনারা না পাইয়া ২৩ দিন পর (১৩ আগস্ট সি আর মামলা নং ৯৩/২০) মুন্সীগঞ্জ আদালতে গিয়ে মামলা করি। স্বজন (রজ্জবের শ্যালক) পার্শ¦বর্তী বাসাইল ইউপি ১নং ওয়ার্ড সদস্য সালাউদ্দিন জানান, রাতে খবর পাইয়া দেখে যাই। পরদিন সকাল ৮ টার দিকে আসি, তখন গোসল দিয়া দাফনের প্রস্তুতি নিতে দেখি। আমি বলি এটা মার্ডার হইছে শুনলাম পুলিশকে জানান নাই। সমাজের লোকজন বলে এখন ভেজাল কইরেন না। পরে বইসা সমাধান করবোনে। এর ৫ দিন পর ৩ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নিয়া বসছিল কোন সমাধান হয়নাই।
স্বজন (রজ্জবের বড় ভাই) মনসুর আলী জানান, ভাই ভাই ঝগড়া হইছে। ভাই কি ভাইকে মারতে পারে। রজ্জবের হার্টের সমস্যা ছিল। স্ট্রোক কইরা মইরা গেছে। এখন ভাই মরার দুঃখে বাঁচিনা তার মধ্যে দুইভায়ের নামে মামলা দিছে। মরার ৫ দিন পর কেয়াইন ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ আলী, বাসাইল ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ও কেরানীগঞ্জের বাস্তা ইউপি চেয়ারম্যান আজগর আলী মীমাংসায় বসে ছোটজনকে (আইউব) ১০ লাখ ও বড়জনকে (আব্দুল) ৫ লাখ, মোট ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করে। তারা মানে নাই, এত টাকা দিবে কেন? চেয়ারম্যানরা আমাদের কোন কথা শোনতে চায়নাই। প্রত্যক্ষদর্শী চায়ের দোকানদার মন্টু মিয়া জানান, আমার দোকানের সামনেই ঝগড়া হয়। আইউব যাইতে লইছিল। রজ্জব একটা কঞ্চি নিয়া আইউবরে মারতে যায়। আমার দোকানের সামনে একটা ট্রাক ছিল আমি আর দেখতে পারি নাই। তখন দোকান বন্ধ করতে ছিলাম। প্রত্যক্ষদর্শী দেলোয়ার জানান, আমি দোকানে চা খাইতে আসছি, দেখলাম তারা ৩ ভাই হিসাব নিয়া বসছে। হঠাৎ রজ্জব চাচা উত্তেজিত হইয়া আইউবরে জুতা নিয়া উঠছে। আমি জুতাটা নিয়া রখলাম। এর কিছুক্ষণ পর বড়জন আব্দুল চাচা আইউবরে গালাগালি কইরা পাঠাইয়া দেয়। তখনও রজ্জবের জিদ কমে নাই, সে দোকানের পাশ থেকে একটা কঞ্চি নিয়া আইউবরে যাইয়া দুইটা বাড়ি মারছে তখন আইউব তারে চাপ দিয়া ধরছিল। সে সময় তার স্ত্রী সন্তানরাও আইসা পড়ছে। তখন বড়জন আইউব চাচা তাদের ধমকাইয়া ছাড়ায় দেয়। এসময় রজ্জব চাচার লুঙ্গি খুইলা গেছিল আব্দুল চাচায় ধইরা হাতে দিছে। এরপর রজ্জব চাচা দোকানের সামনে আইসা আস্তে কইরা বইসা পড়ে। তারপর সেন্সলেস হইয়া যায়। এরপর সবাই ধরাধরি কইরা বাড়ির দিকে নেয়। আধাঘন্টা পর আসকর চাচার গাড়ি দিয়া ঢাকা নিয়া যায়। কেয়াইন ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আশ্রাফ আলী জানান, আমরা তাদের পারিবারিক ঝামেলা নিয়া বসেছিলাম। সেটা সমাধান হয়নাই। আর হত্যা যদি হয়, সেটা চেয়ারম্যানদের বিচার করার কোন ক্ষমতা নাই। সেটা আদালতের ব্যাপার। সিরাজদিখান থানা অফিসার ইনচার্জ মো. ফরিদ উদ্দিন জানান, হত্যার মত ঘটনা যদি হয়, তাহলে তাৎক্ষণিক আমাদের জানালে ব্যবস্থা নেই। এমন কোন ঘটনা আমাদের কেউ জানায়নাই। তবে যে বিষয়টা বললেন সে বিষয়ে দাফন কাফনের ২০/ ২২ দিন পর তারা এসেছিল। আদালতে সি আর মামলা হয়ে থাকলে আমরা ব্যবস্থা নিব।