দাম কমাতে অ্যাসোসিয়েশনের অনুরোধ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বছরে দেশের আলুর চাহিদা ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন। এ বছর উৎপাদনও হয়েছে একই পরিমাণ। তবে অপচয় হিসাব করলে ৫ লাখ টনের মতো ঘাটতি রয়েছে। আর এ ঘাটতির সুযোগেই নতুন ইতিহাস লেখা হচ্ছে আলুর বাজারে। মৌসুমের শুরুতে যে আলুর দাম খুচরায় ছিল ১৬ থেকে ১৮ টাকা। তা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড ভেঙে হাফ সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে ঠেকেছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। বাড়তি দাম নিয়ে মুন্সীগঞ্জের ক্রেতা ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন কোল্ডস্টোরেজ ও আড়তের মালিকদের। আর মালিকরা বলছেন, বাড়তি এ টাকা পাচ্ছে কয়েক বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষক। কারণ কোল্ডস্টোরেজে তারাই আলু রাখছে। সরকারি সংস্থা বিপণন ও বাজার মনিটরিং সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সংস্থাটির হিসাব বলেছে, গত সোমবার বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। ১ মাস আগেও এ আলুর দাম ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আর ১ বছর আগে ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। সে হিসাবে মাসের ব্যবধানে প্রায় ২৯ শতাংশ এবং গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১১ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ গত বছরের এই সময়ের চেয়ে দাম দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। যদিও খুচরা বাজারে আলুর দাম আরও বেশি। মুন্সীগঞ্জের বেশিরভাগ বাজারেই আলু ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গেল বছরের একই সময়ে খুচরা বাজারে দাম ছিল ২০ থেকে ২২ টাকা, আর পাইকারি বাজারে দাম ছিল ১৬ থেকে ১৮ টাকা। বছরের ব্যবধানে খুচরা ও পাইকারিতে দাম বেড়ে প্রায় আড়াই গুণ হয়েছে। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আলুর দাম স্বাধীনতার আগে বা পরে কখনোই এত বাড়েনি। গত মৌসুমে আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। তাই হিমাগারে রাখা হয়েছে তুলনামূলক কম। করোনা ও বন্যার কারণে অন্যান্য সবজির উৎপাদন কমে যাওয়ায় আলুর চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। তবে যে হারে দাম বেড়েছে তা অনেক বেশি। দাম নিয়ন্ত্রণে তদারকি করতে হবে হিমাগারগুলোতে। এসব হিমাগার আলু উৎপাদন হওয়া বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত। তারা বেশি দামের আশায় মজুতকৃত আলু বাজারে ছাড়ছে না।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বছরে আলুর চাহিদা প্রায় ৮৫ লাখ টন। এবার দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে ৮৫ লাখ টন। তোলা ও সংরক্ষণ পর্যায়ে কিছু আলু নষ্ট হয়ে যায়, যা এখন কিছুটা ঘাটতিতে রূপ নিয়েছে। যদিও গত কয়েক বছর ধরে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছিল। আগের ২ বছর উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ লাখ ৫ হাজার ও ১ লাখ ৭ হাজার টন। দেশের আলু উৎপাদন ও বাজারজাতের বেশিরভাগই মুন্সীগঞ্জ, যশোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রাজশাহী, নীলফামারী এ জেলাগুলো থেকে আসে। মৌসুমের শুরুতে এসব জেলায় প্রতি বছর আলুর পাইকারি মূল্য থাকে ৭ থেকে ৮ টাকা। এবার দাম কিছুটা বেড়ে ১০ থেকে ১২ টাকার মধ্যেই ছিল। ৫০ কেজির প্রতি বস্তার দাম ছিল ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকার মতো। মার্চ পর্যন্ত সেসব আলুই সংরক্ষণ হয়েছে বিভিন্ন হিমাগারে। ৬ মাসে কেজিতে খরচ হয়েছে ২ টাকা। নতুন মৌসুমের আলু পুরোদমে বাজারে আসতে আরও ৩ থেকে ৪ মাস বাকি রয়েছে। এ অবস্থায় গত সেপ্টেম্বর থেকেই অস্থির হতে শুরু করে আলুর বাজার। অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণে কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন খরচ ৮ টাকা ৩২ পয়সা ধরে হিমাগার থেকে কেজিপ্রতি আলু সর্বোচ্চ ২৩ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ২৫ টাকা ও খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা দরে আলুর দাম নির্ধারণ করে দেয় সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে হিমাগার মালিকদের চিঠিও দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রভাব আলুর বাজারে পড়েনি। দিন দিন এ পণ্যটির দাম বেড়েই চলছে। তবে হিমাগারের মালিকরা বলছেন, তাদের কাছে থাকা আলুর মালিক কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। ভাড়ার বিনিময়ে তারা শুধু আলু সংরক্ষণ করেন। এবার আলু উৎপাদনও কম হয়েছে, ফলে মৌসুম শেষ হওয়ায় দামও বাড়িয়েছেন তারা। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দাম বাড়াচ্ছে বলে হিমাগার মালিকদের দাবি।
হিমাগারের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, শেষ হওয়া মৌসুমে আলুর উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কম হয়েছে। আগের বছর আলুর উৎপাদন যেখানে ১ কোটি ৫ লাখ টন ছিল এ বছর তা ৮৫ লাখ টনে নামে। ফলে গত বছরের চেয়ে ২০ লাখ টন কম উৎপাদন হয়েছে। মজুত কম থাকায় ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন, আলুর দাম আরও বাড়বে। তাই অনেকে হিমাগার থেকে আলু তুলছেন না। তাদের তথ্য মতে, ডিসেম্বরে শেষ হওয়া মৌসুমে ৮৫ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। দেশে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ কোল্ডস্টোরেজ রয়েছে। কোল্ডস্টোরেজগুলোতে গত মৌসুমে আলুর মজুত ছিল ৫৫ লাখ টন। এবার হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয় ৪০ লাখ টন। এর মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ টন আলু বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ১০ লাখ টন বীজের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। সে হিসাবে হিমাগারে বিক্রির মতো রয়েছে ৮ থেকে ১০ লাখ টন আলু। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝিতেই আবার নতুন আলু বাজারে আসতে শুরু করবে। এদিকে আলুর দাম যাতে আরও না বাড়ে সেজন্য কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সব কোল্ডস্টোরেজ মালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বর্তমান বাজারে আলুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও হিমাগারে সংরক্ষণকারী কৃষক, বেপারি ও ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় হিমাগার থেকে আলু উত্তোলন করছে না। কোনো কোনো হিমাগার থেকে খুবই ধীরগতিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে যাতে কেউ আলুর স্টক না রেখে দেয়, আর আলুর দামও নাগালের মধ্যে থাকে তার অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোশারফ হোসেন বলেন, কয়েক বছর লোকসান গোনায় এ বছর আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। তাছাড়া বৃষ্টির কারণে আগাম জাতের আলুর বীজ রোপণ করতে পারছেন না কৃষক। এসব নতুন আলু আগামী ডিসেম্বরের আগেই বাজারে আসার কথা ছিল। কিন্তু তা না হওয়ায় ডিসেম্বরের দিকে বাড়তি দাম পাওয়ার আশায় অনেকেই নিজেদের স্টকে থাকা আলু বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। তবে এসব আলুর বেশিরভাগের মালিক প্রান্তিক কৃষক। তারা গত কয়েক বছর দাম কম পেয়ে লোকসান গুনেছেন। এবার তাই ক্ষতি পোষাতে এখনই বিক্রি করতে চাইছেন না। তবে, বর্তমানে বাজারে আলুর যে দাম তা বেশ অস্বাভাবিক। তাই আলুর দাম যাতে আরও না বাড়ে সেজন্য কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সব কোল্ডস্টোরেজ মালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।