শত শত মানুষের বোবা কান্না ; প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার হোসেন্দী ইউনিয়নের ৩টি গ্রামের ১৬শ মানুষের ভিটেমাটি দখলে নিতে সিটি গ্রুপের ভয়াবহ থাবা পড়েছে। সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র চালানো হচ্ছে আদিম বর্বরতার মত নির্যাতন। ফলে সিটি গ্রুপের দখল বাণিজ্যে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে রঘুর চর, ডোবার চর ও নতুন চর নামে ৩টি গ্রাম। এতে করে অচিরেই তিনটি গ্রাম হারিয়ে যাবে মানচিত্র থেকে। ভিটেবাড়ি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম এখন তিন গ্রামের ১৬ শতাধিক মানুষ। এই ৩টি গ্রামের চারদিকে কিছু জমি ক্রয় করে চারপাশে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রামগুলোর মানুষ যাতে সহজে বের হতে না পারে সেজন্য পরিকল্পিতভাবে দুইটি গেইট নির্মাণ করে সেখানে পাহারা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় গ্রামবাসীদের প্রতিদিনের যাতায়াতে প্রতিনিয়ত বাঁধার সৃষ্টি করছে। এই তিন গ্রামের মানুষের আত্মীয়স্বজনদের এই গেইট দিয়ে যেতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি রঘুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও মাদরাসায় কেউ যেতে চাইলেও বাঁধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। গেইটে নিয়োজিত দারোয়ানরা জানিয়ে দিচ্ছে এসব এখন সিটি গ্রুপের দখলে। কাজেই অনুমতি ছাড়া সেখানে যেতে দেয়া হবে না। এই অনুমতি ঢাকা সিটি গ্রুপের প্রধান কার্যালয় থেকে আনতে হবে। যেকোন ব্যক্তি সেখানে গেলেই এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। অপরদিকে স্থানীয় কতিপয় সন্ত্রাসী লোকজনকেও এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই স্থানীয় স্বার্থান্বেষীদের মধ্যে যাদের কর্মসংস্থান ছিল না, অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করতো তারা এখন প্রাইভেটকার চালায়, বিত্তবৈভবের মালিক। দিনদিনই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া মানুষের সংখ্যা সিটি গ্রুপের মাধ্যমে বাড়ছে। এই স্বার্থান্বেষী মহলের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ। এমন অভিযোগ গজারিয়ার হোসেন্দী ইউনিয়নের সর্বস্তরের মানুষের। এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার হোসেন্দী ইউনিয়নে ১০৮ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে সিটি গ্রুপের অর্থনৈতিক অঞ্চল। এজন্য সেখানে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালের মে মাসে সিটি গ্রুপকে প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রাকযোগ্যতার সনদ প্রদান করেছে বেজা। স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, সিটি গ্রুপ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা দেয় ১০৮ একর জমির উপর। এই ১০৮ একর সম্পত্তিতে ৩ গ্রামের সাধারণ মানুষের অংশ আছে কি না, নাকি অন্যের সম্পত্তি দখল দেখিয়ে তারা তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা দেয় সেটাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এই অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নামে চলছে দখল বাণিজ্য। সিটি গ্রুপে নিয়োজিত লোকজনের থাবা পড়েছে মেঘনা নদীবিধৌত তিনটি গ্রামে। এই তিনটি গ্রামে রয়েছে এখনো ১৬ শত মানুষের বসবাস। সেখানে রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাদরাসা ও ৩টি মসজিদ। এসব প্রতিষ্ঠান এখন সিটি গ্রুপের দখলে পরিণত হয়েছে। তিন গ্রামের মানুষ সিটি গ্রুপে নিয়োজিত দখলদার বাহিনীর দাপটে সর্বদা থাকে তটস্থ। ভয়ে মুখ খুলে আর্তনাদ জানানোরও সাহস পাচ্ছে না। নিরবে নিভৃতে কাঁদছে সেই তিন গ্রামের অসহায় হয়ে পড়া মানুষ। সিটি গ্রুপের দখলদার বাহিনীর হুমকি ধমকিতে শত শত পরিবার ভিটেবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যারা নামমাত্র মূল্যে ভিটেবাড়ি সিটি গ্রুপের কাছে বিক্রি করতে অসম্মতি জানায় তাদের উপর চালানো হয় নিপীড়ন ও নির্যাতন। এই সিটি গ্রুপের দখলদার বাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সেখানকার ১৬ শত মানুষ। অত্যাচারের শিকার এসব মানুষের ক্ষোভ ও আর্তনাদ প্রকাশেরও ভাষা নেই। মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়া গ্রামের মানুষ এখন তাদের ভিটেমাটি ফিরে পেতে ও নিজের বাড়িতে টিকে থাকতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। গজারিয়া উপজেলার হোসেন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উক্ত ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারমান আব্দুল মতিন মন্টু দৈনিক মুন্সীগঞ্জের কাগজকে জানান, সিটি গ্রুপ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার নামে চালাচ্ছে দখল বাণিজ্য। এই গ্রুপের দখলদার বাহিনীর নিপীড়ন নির্যাতনে নতুন চর ও ডোবারচরের মানুষ এখন গ্রামছাড়া। যারা এখনো অত্যাচার নিপীড়ণ সহ্য করে টিকে রয়েছে তারাও নামমাত্র দামে সিটি গ্রুপের কাছে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে নতুনচর ও ডোবার চর মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে। এর প্রতিবাদে অচিরেই মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করা হবে বলে তিনি জানান। তিনি অভিযোগে আরো জানান, সিটি গ্রুপের দখল ও ভরাট কার্যক্রমে মেঘনার একটি শাখা নদী ইতিমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়া পানি চলাচলের খালটিও ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সরকারিভাবে বন্দোবস্ত দেয়া গরিব অসহায় মানুষের জমিও এই সিটি গ্রুপের দখলদারদের খপ্পরে পড়েছে। ফলে অনেক অসহায় গরিব মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে পথের ভিখারীতে পরিণত হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের ছত্রছায়ায় সিটি গ্রুপ এই দখল বাণিজ্য ও এলাকাবাসীর উপর অত্যাচার নিপীড়ণ চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করছে। কামাল হোসেন নামে একজন ভুক্তভোগী জানান, তার ভিটেমাটি লিখে দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। না দেয়ায় তিনি নির্যাতনের শিকার। নতুন চর ও ডোবারচরের মানুষ সিটি গ্রুপের অত্যাচারে এখন প্রতিবাদ করারও সাহস পাচ্ছেনা। ক্ষোভে দুঃখে গুমড়ে কাঁদছে সেখানকার তিনগ্রামের মানুষ। হোসেন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাবউদ্দিন দৈনিক মুন্সীগঞ্জের কাগজকে জানান, সিটি গ্রুপের থাবায় এখানকার শত শত মানুষ নীরবে কান্না করছে। প্রতিবাদ করলেই তাদের উপর নেমে আসে অত্যাচার নিপীড়ণ। ফলে গুমড়ে কাঁদছে সেখানকার অসহায় মানুষ। হোসেন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাবউদ্দিন অভিযোগে জানান, সিটি গ্রুপের সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে একটি নিরীহ পরিবার ৫৬ শতাশ জমি হারিয়ে এখন পথে বসার উপক্রম। জমির মালিকানা কাগজে মূলে থাকলেও দখল করে নিয়েছে সিটি গ্রুপ। এই পরিবারের এতিম সন্তানরা জমি ফিরে পেতে ভূমিমন্ত্রীসহ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। হোসেন্দী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, চর বলাকী নতুনচর সরকারি প্রাথমিক বিদালয়টি সিটি গ্রুপের থাকার শিকারে পরিণত হবার উপক্রম। এছাড়াও রঘুরচর, ডোবার চর ও নতুন চরে তিনটি মসজিদ ও একটি মাদরাসা সিটি গ্রুপের দখলে চলে যাচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করারও সাহস পাচ্ছে না। হোসেন্দী ইউনিয়নের রঘুরচর মৌজার মোঃ দীন ইসলাম নামে জনৈক ব্যক্তি ১৫ শতাশ জমির মালিক। সিএস খতিয়ানের ৫০ এর দাগ নং ১১২, এস এ খতিয়ান নং ১৩। সেখানে তার বসতঘর রয়েছে। কিন্তু সিটি গ্রুপের দখলদার বাহিনীর হুমকি ধমকিতে তিনি বাড়িছাড়া। এই ভিটেমাটি জোরপূর্বক নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে সিটি গ্রুপের সন্ত্রাসী বাহিনী বলে তিনি অভিযোগে জানান। সিটি গ্রুপের দ্বিতীয় গেইট সলগ্ন স্থানের এক ব্যবসায়ী জানান, এই সিটি গ্রুপের দখলদার বাহিনীর থাবায় সব হারিয়েছি। আমাদেরকে মারধর করা হয়েছে। ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছিনা। শত শত মানুষ এই সিটি গ্রুপের কাছে এখন জিম্মি হয়ে পড়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীরা জানান, আমরা নতুনচর ও ডোবারচরের অধিকাংশ মানুষ জেলে ও কৃষক। মেঘনা নদীতে মাছ ধরে ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের কৃষিজমি সিটি গ্রুপ দখল করে নিয়ে চারপাশে বেড়া দিয়ে বাউন্ডারি করে ফেলেছে। এর ভিতরে কি হচ্ছে তা দেখারও সুযোগ কারো হয় না। কারণ সিটি গ্রুপের ভিতরে ঢোকার কারো সাধ্য নেই। গেইটে গেলে বলা হয়, বড় সাহেবের অনুমতি লাগবে। আর এই বড় সাহেবের হদিস কেউ পায় না। জানা গেছে, সিটি গ্রুপের সেখানে দুটি গেট রয়েছে। এই গেইটে নিয়োজিত রয়েছে সন্ত্রাসী বাহিনীর লোকজন। হাজার চেষ্টা করেও সেখানে ঢোকার অনুমতি মেলে না। তাই সিটি গ্রুপের বাউন্ডারির ভিতরে কি হচ্ছে তা জানা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। স্থানীয় কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল সিটি গ্রুপের নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে এই দখল বাণিজ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে। তাই এ বিষয়টিও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে এলাকাবাসীর দাবি।