বিশেষ প্রতিবেদক
দেশের বিপুলসংখ্যক ফার্মেসিতে মানহীন ওষুধ বাজারজাতের শঙ্কা আরো বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় ফার্মেসি অনেক বেশি। আর কর্তৃপক্ষ ফার্মেসির সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়াচ্ছে। কিন্তু তদারকি নেই। ফলে দিন দিন আরো তীব্র হচ্ছে মানহীন ওষুধ বাজারজাতের শঙ্কা। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২০-২১) বলা হয়, দেশে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮৯টি নিবন্ধনধারী ওষুধ বিক্রির ফার্মেসি রয়েছে। এরপর ওই বছরের জুন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে আরো ৪৬ হাজার ৮৭৯টি ফার্মেসিকে নিবন্ধন দেয়া হয়। বর্তমানে দেশে মোট ফার্মেসির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৪৮৬টি। এসব ফার্মেসিকে নির্ধারিত নিয়ম মেনেই নিবন্ধন দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়। সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা জেলায় ফার্মেসির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ জেলায় ২৭ হাজার ৮০০ ফার্মেসি রয়েছে। আর সবচেয়ে কম পার্বত্য জেলা বান্দরবানে, ৪৫০টি। বিভাগভিত্তিক হিসেবে ঢাকার ১৩টি জেলায় ফার্মেসি রয়েছে ৫৬ হাজার ৯২৭, ময়মনসিংহের চার জেলায় ১০ হাজার ৯০১, সিলেটের চার জেলায় ১০ হাজার ৮৯৬, চট্টগ্রামের ১১ জেলায় ৩৬ হাজার ৬৯৫, বরিশালের ছয় জেলায় ১৪ হাজার ৩৮৬, রংপুরের আট জেলায় ১৮ হাজার ৩২৭, খুলনার ১০ জেলায় ২৫ হাজার ৯৯৭ ও রাজশাহীর আট জেলায় ফার্মেসি রয়েছে ২৮ হাজার ৩৯৯টি। ওষুধ খাত এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ফার্মেসিতে ওষুধ সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে রয়েছে বহুবিধ নিয়মকানুন। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়মিতভাবে এসব দেখভাল করার দায়িত্ব। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনীয়তা যাচাই-বাছাই না করেই দেশে হাজার হাজার ওষুধের দোকানকে নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৪৬ হাজার ওষুধের দোকানকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। মাত্র পাঁচ মাসে এতোসংখ্যক ফার্মেসিকে নিবন্ধন দেয়ায় ওষুধের মান ও গুণাগুণ বজায় রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ তাতে নকল, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন ওষুধ বাজারজাতের আশঙ্কা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ওষুধের মান শুধু কাঁচামাল ও উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে না। যথাযথভাবে সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন করা না হলেও ওষুধের গুণাগুণ নষ্ট হয়। কখনো কখনো তা জীবনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় ফার্মেসি অনেক বেশি। প্রতিনিয়তই কর্তৃপক্ষ ফার্মেসির সংখ্যা বাড়াচ্ছে। ওষুধের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করা হচ্ছে। এসব ফার্মেসিকে ১৯৪৬ সালের ওষুধ আইন (দ্য বেঙ্গল ড্রাগ রুলস ১৯৪৬) অনুযায়ী আবেদনের বিপরীতে নিবন্ধন দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এর জন্য নির্দিষ্ট কাগজপত্র আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হয়। নিয়ম আনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর নিবন্ধন নবায়নও করতে হয় ফার্মেসিগুলোকে। মূলত মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ দুই শ্রেণিতে বর্তমানে নিবন্ধন দিচ্ছে অধিদপ্তর। এর বাইরেও রয়েছে পাইকারি ফার্মেসি, হোমিওপ্যাথিক খুচরা ফার্মেসি, হারবাল খুচরা ফার্মেসি, ইউনানি খুচরা ফার্মেসি, আয়ুর্বেদিক খুচরা ফার্মেসি ও অ্যালোপ্যাথিক খুচরা ফার্মেসি। সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ২২০টি অ্যালোপ্যাথিক, ২৪৬টি ইউনানি, ১৫৮টি আয়ুর্বেদিক, ৫১টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩৩টি হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশীয় চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। তাছাড়া ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে এসব প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০২২ সালেও ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ওষুধ রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু দেশে দুই-তৃতীয়াংশ ওষুধের দোকানে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। ওষুধ সংবেদনশীল পণ্য। তাপমাত্রার কিছুটা হেরফের হলেই কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। দেশে যে ধরনের ওষুধ রয়েছে তার প্রায় ৯০ শতাংশই ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। ওষুধভেদে সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার ভিন্নতা রয়েছে। ওষুধ ঠান্ডা ও শুকনো স্থানে আলোর আড়ালে রাখতে হয়।