নিজস্ব প্রতিবেদক
এবার রোজা শুরু হবে মার্চের মাঝামাঝি। হাতে রয়েছে দুই মাসের কিছু বেশি সময়। রমজান মাসে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। তাই আমদানি শুরুর এখনই সঠিক সময়। আন্তর্জাতিক বাজারে অধিকাংশ পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় কম। কিন্তু ডলার সংকটে এলসি খুলতে সমস্যা এবারও প্রকট। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার রোজার বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিয়ে স্বস্তির চেয়ে চাপ বেশি। ডলার ও আমদানি সংক্রান্ত সমস্যা না কাটলে পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে।
রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মজুত ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে সরকার। বাড়তি চাহিদা সামনে রেখে ছয়টি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি অন্য ব্যাংকগুলো শূন্য মার্জিনে এলসি খোলা এবং কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘পণ্য আমদানিতে যেন পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করা হয় সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হবে। এখন পণ্যের সরবরাহ কিছুটা কমলেও সার্বিকভাবে আমদানি মোটামুটি স্বাভাবিক। একই সঙ্গে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো যেন কম বা শূন্য মার্জিনে এলসি খোলে সে বিষয়ে অনুরোধ জানানো হবে।’
তিনি বলেন, ‘এবার খেজুর আমদানিতে কিছু সমস্যা হচ্ছে। শুল্ক কমাতে কিছুদিন আগে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এজন্য বন্দরে আনা খেজুরও ব্যবসায়ীরা খালাস করছেন না। বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হবে।’
তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধান হলে খুব বেশি সমস্যা হবে না। কারণ ভোজ্যতেল ও চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল। ডাল, ছোলার দামও স্থিতিশীল। দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো, দাম কম হবে। তাই সার্বিকভাবে বলা হয় রমজানে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল থাকবে।’
জানা যায়, এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছয়টি পণ্য আমদানিতে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হবে। পণ্যগুলো হলো- ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুর। গত বছর আটটি পণ্যের ক্ষেত্রে এ অনুরোধ করা হয়েছিল। ওই ছয় পণ্যের সঙ্গে ছিল মসলা ও মটর ডাল।
তবে বাস্তবতা হলো, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে রোজার ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে চিন্তিত সাধারণ মানুষ। কারণ বাজার দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক চড়া। কোনো পণ্যের দাম কমছে না। এমনকি দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমার কোনো সুখবরও নেই বেশ দীর্ঘসময়। যদিও বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমেছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের বাড়তি দামসহ নানা কারণে সে সুফলও পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।
আয়-ব্যয়ের সঙ্গে কুলাতে না পেরে অনেকে নিত্যপণ্য কেনাকাটায় কাটছাঁট করছেন।
এমন একজন ভোক্তা হাজিপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘এখনই ঠিকঠাক খেতে পারি না। কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্য কেনাও কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। ভালো খাবার কাটছাঁট করে সংসার খরচ সামাল দিতে হচ্ছে। রোজায় এখন যা খাচ্ছি সেটাও জুটবে কি না সে চিন্তা হচ্ছে আরও আগে থেকে।’
রোজার বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো সুখবর দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। বরং তারা আমদানি পণ্য সরবরাহ নিয়ে নানান ধরনের সমস্যার কথা বলছেন। ডলার সংকটে এলসি খোলার সমস্যা ছাড়াও ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা, যা প্রত্যক্ষভাবে বড় প্রভাব ফেলছে পণ্যের দামে।
বর্তমানে বেশকিছু পণ্যের সরবরাহ সংকট রয়েছে। এছাড়া গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, ভারতের পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়া, ব্রাজিল থেকে পণ্য আমদানিতে কিছু বাধাসহ নতুন করে লোহিত সাগরের চ্যানেলে কিছুটা সমস্যা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তারা। সার্বিক ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বড় চাপ তৈরি করেছে এটা।
গত বছরের মতো ডলার সংকটে বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতার শঙ্কাও করছেন কিছু ব্যবসায়ী। ডলার সংকটে বিল পরিশোধ না করতে পারায় গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন আমদানিকারকের পণ্য আটকে যায়। সেসময় বিলম্বের জন্য তাদের পণ্য খালাসে বাড়তি জাহাজ ভাড়া ও জরিমানাও গুনতে হয়। সেখানে এস আলম গ্রুপ এবং মেঘনা গ্রুপের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের পণ্যও ছিল।
জানতে চাইলে দেশের অন্যতম পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘রমজানের পণ্য পরিস্থিতি ভালো নয়। প্রচন্ড চাপ থাকবে। ডলার সংকটে সব কোম্পানি ভুগছে। আমাদের শতভাগ মার্জিন দিতে হচ্ছে। পণ্য আমদানি করতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া ফ্রেড (জাহাজ ভাড়া) বেড়ে গেছে। লোহিত সাগরে বেশ কয়েকটি পণ্যবাহী জাহাজ হামলার শিকার হওয়ার পর বিশ্বের বড় বড় জাহাজ কোম্পানি ওই সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল আপাতত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। যে কারণে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভাড়া বেড়েছে। আগে প্রতি টন পণ্যে ৫০ ডলার ভাড়া ছিল, যা এখন ৭০-৭৫ ডলার হয়েছে।’
তসলিম শাহরিয়ার আরও বলেন, ‘বেশকিছু সময় থেকেই সবার ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে নতুন করে আবার গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। সবকিছু মিলে কী হবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে ভালো কিছুর সম্ভাবনা কম।’
রমজানে অতিপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ছোলা ও ডাল। বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি বিকাশ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ছোলা ও ডালের দাম বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে এ খাতের ছোট আমদানিকারকেরা এলসি করতে পারছে না। সেজন্য আমরা কোটা সুবিধা চেয়েছিলাম এলসির ক্ষেত্রে, সেটা হয়নি। ব্যাংকগুলো আমাদের মতো ছোট আমদানিকারকদের সুযোগ দিচ্ছে না।’
খেজুর ও তাজা ফলের অন্যতম আমদানিকারক এবং বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানি করে খেজুর আনতে দুই মাস সময় লাগে, কিন্তু আমরা পর্যাপ্ত ঋণপত্র খুলতে পারছি না। খেজুরের আমদানি শুল্ক কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। এনবিআর ও কাস্টমসের কথা বলা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। তবে এখনো কোনো সমাধান হয়নি।’
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর রমজানের আগেই নিত্যপণ্যের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ অধিদপ্তর দফায় দফায় বৈঠক করে নিত্যপণ্য আমদানিকারক, প্রস্তুতকারক, পরিবেশক, পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ীসহ এফবিসিসিআই নেতাদের সঙ্গে। কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়। ব্যবসায়ীদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর সুফল পান না সাধারণ ভোক্তারা।
এর পেছনে থাকে আরও কিছু কারণ। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজার সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় প্রায় প্রতি রমজানে বাড়ে পণ্যের দাম।
পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে সরকার টিসিবি ও ওএমএস কার্ড দিয়ে ভর্তুকি মূল্যে কয়েকটি নিত্যপণ্য বিক্রি করে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কম দামে দুধ, ডিম, মাংস বিক্রি শুরু করে। ট্রাকসেলে কিছু কম মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করে কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি। তবে এসবের সুফল পায় হাতেগোনা কিছু মানুষ।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘এখনই বাজারে কোথাও সিন্ডিকেট কাজ করছে, কোথাও মুদ্রাস্ফীতির পরিবেশ কাজে লাগিয়ে অতি মুনাফালোভীদের সক্রিয় করা হয়েছে। ক্রেতা প্রতারণার নানা ক্ষেত্র এখন বাজারে। রমজানে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে আইন আরও কার্যকর প্রয়োজন। কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন।’
রমজানে ভোগ্যপণ্য সরবরাহে স্বস্তির চেয়ে চাপ বেশি
আগের পোস্ট