ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক ও শ্রমিকেরা
কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু, আড়িয়ল বিল থেকে ফিরে : মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর ও সিরাজদিখান উপজেলার অন্তর্গত আড়িয়ল বিলে পাকা ধান কাটার মধ্য দিয়ে কৃষক পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে নবান্নের উৎসব। হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে শত শত কৃষাণ-কিষাণী। প্রচন্ড গরমে শরীরের ঘাম ঝড়লেও তাদের মুখে এখন নেই দুশ্চিন্তার ছাপ। এবার ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি থামছেই না।
দেশের বৃহত্তম আড়িয়ল বিলে গত এক সপ্তাহ ধরে পাকা ধান কাটা শুরুর পর থেকে কৃষাণ-কিষাণীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধান কাটার অত্যাধুনিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার যন্ত্র। ধান মাড়াই করতে বোঙ্গা ব্যবহার করা হচ্ছে সমান তালে। অন্যদিকে জীবিকার তাগিদে নবান্নের উৎসবে ধান কাটার কর্মযজ্ঞে শামিল হতে ফরিদপুর ও শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে কয়েক হাজার শ্রমিক। এসব শ্রমিকেরা কৃষকের পাকা ধান কাটার পর মাড়াই, ঝাড়াইসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তাই জমির পাকা ধান কাটায় ব্যস্ত থাকা কৃষকের চোখে মুখে এখন স্বস্তির চিহ্ন।
আড়িয়ল বিলের আলমপুর, বাড়ৈখালী, হাঁসাড়া, চোরমর্দন, শ্রীধরপুর ও মদনখালী ঘুরে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে এখন ধান কাটার মহোৎসব চলছে। এবার আড়িয়ল বিলে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই ধানে ধানে ভরে উঠেছে আড়িয়ল বিল। পাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধে দেহ-মন জুড়িয়ে ফুটিয়ে তুলছে কৃষক-কৃষাণীর মুখে আনন্দের হাসি। দখিনা বাতাসে সোনালি ধানের মৌ-মৌ ঘ্রাণে আড়িয়ল বিলের কৃষক-কৃষাণীর বুক ভরে গেছে। যেন নবান্ন উৎসবে মেতে উঠেছেন বিলের চোরমর্দন গ্রামের রহিমা বেগম, হাতিম আলী, করিম খাঁ, রমিজ বেপারীর মতো হাজার হাজার কৃষক ও কৃষাণী।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্রমতে, প্রায় এক লাখ বর্গাচাষি এই আড়িয়ল বিলে ধান চাষ করে থাকেন। বিলের প্রায় ১৪ হাজার ১৬৪ হেক্টর জমিতে এবার ধান চাষ করা হয়েছে। আর জেলার ৬ উপজেলা মিলিয়ে এবার ধান চাষ করা হয়েছে ২৫ হাজার ১৬২ হেক্টর জমিতে। আর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার ১৪৭ হেক্টর। অর্থাৎ পুরো জেলায় উৎপাদিত ধানের মধ্যে অর্ধেক পরিমাণ ধান আবাদ হয় শুধু আড়িয়ল বিলে।
বিলের ধানচাষী বারেক মিয়া জানান, এবার তিনি ৫ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ করেছেন। এখন পাকা ধান কেটে ঘরে বা আঙিনায় তোলার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
গাদিরঘাট গ্রামের ধানচাষী আব্দুল কাদের মিয়া জানান, কৃষককূল এখন পাকা ধান কেটে বাড়ির আঙিনায় নিতে ব্যস্ত।
একই কথা জানালেন আড়িয়ল বিলের আলমপুরের কৃষক আলম চাঁন মুন্সী ও লস্কপুরের মহসিন ঢালী। তবে আড়িয়ল বিলের সর্বত্র সাপের পদচারণা থাকায় চাষীরা পাকা ধান কাটতে গিয়ে সাপের ছোবলে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন বলেও জানান আলম চাঁন মুন্সী।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে ভেজা ধানের মণ কেনাবেচা হচ্ছে ৯০০ টাকা করে। ঝাড়া-শুকনা ধানের মণ প্রকারভেদে বেচা-কেনা হচ্ছে ১১০০-১২০০ টাকা। অপরদিকে উপজেলার অন্যান্য চকের বেশিরভাগ জমিতে ধান এখনো পরিপক্ব হয়নি।
আড়িয়ল বিলের শ্যামসিদ্ধি গ্রামের মোঃ আমান বেপারী বলেন, এবার জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগের কারণে ধানের ফলন কম হয়েছে। প্রায় ৫ কানি জমিতে ২৮ ও ২৯ জাতের আবাদ করা পাকা কাটা শুরু করেছি।
তিনি বলেন, বর্তমানে বোঙ্গায় মাড়াইকৃত ভেজা ধানের মণ পাইকারের কাছে ৯০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। একজন কৃষি শ্রমিককে ৩ বেলা খাবার দিয়ে ধান কাটার দৈনিক মজুরি দিতে হচ্ছে ৮০০ টাকা। প্রতি গন্ডায় (৭ শতাংশ জমি) ধান পাওয়া যাচ্ছে ৪ মণের মতো।
গাদিঘাট গ্রামের কৃষক আমিরুল ইসলাম বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে আড়িয়ল বিলে ধান কাটার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মাসব্যাপী এই কৃষি কর্মযজ্ঞ চলবে।
কয়েকজন শ্রমিক বলেন, বৈশাখ মাস জুড়ে আড়িয়ল বিলের বিভিন্ন জমিতে ধান কাটবেন তারা। এক-দুই কিলোমিটার দূরের জমিতে কাটা ধান মাথায় করে লোকালয়ের কাছাকাছি আনতে হচ্ছে। এরপর ধান মাড়াই ও ঝাড়াইসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষে পাক ধান কৃষকের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজে অসংখ্য শ্রমিক ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এদিকে আড়িয়ল বিলের কৃষকদের দাবী, শ্রীনগর, সিরাজদিখান ও দোহার উপজেলার অন্তর্গত আড়িয়ল বিলের সংযুক্ত খাল হিসেবে পরিচিত শ্রীনগর-শ্যামসিদ্ধি খাল, গাদিঘাট-ভেন্নি খাল, শ্রীনগর-আলমপর খাল ও বাড়ৈখালী-মদনখালী খালগুলো নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এসব শাখা খালগুলো পদ্মা, ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদীর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হলেও অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজার দিয়ে কৃষিজমি ভরাট করায় পানি প্রবাহের গতিপথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে চলতি মৌসুমের এই সময়েও খালগুলোতে পানি নেই। তাই এই অঞ্চলে কৃষি ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আড়িয়ল বিলের গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো পুনঃখনন করার দাবী জানিয়েছেন তারা।
শ্রীনগর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টরের কিছু বেশি জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়। এখন ধান কাটার মৌসুম। বর্তমানে কৃষকেরা পাকা বোরো ধান কেটে ঘরে তুলতে অবিরাম কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিলের কিছু এলাকায় পানি আটকে থাকায় এবং নিরিবিলি হওয়ায় সেখানে সাপের বিচরণ রয়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছে।
শ্রীনগর উপজেলা কৃষি অফিসার মোহসিনা জাহান তোরণ জানান, উপজেলায় ১০ হাজার ৪ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে আড়িয়ল বিলের শ্রীনগর অংশে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম ধান চাষ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চলতি মৌসুমে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ৭ শতাধিক কৃষককে বিনামূল্যে ধান বীজ সরবরাহ করা হলে এসব বীজ ৩০টি প্রদর্শণী ক্ষেতে আবাদ করা হয়েছে। উপজেলায় এবার ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ হাজার মেট্রিক টন।
মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, পাকা ধান কাটা শুরু হওয়ায় আড়িয়ল বিলে এখন কৃষকদের মনে বাড়তি আনন্দ বিরাজ করতে দেখা গেছে। ধান কাটার অত্যাধুনিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার যন্ত্রের পাশাপাশি ফরিদপুর ও শরীয়তপুর থেকে এসেছে হাজারেরও বেশি শ্রমিক। বিভিন্ন জেলা থেকে আরও শ্রমিক আসছে আড়িয়ল বিলে।