স্বপ্না আক্তার রাকা: বাংলাদেশের মানচিত্রে একটি জেলার নাম মুন্সীগঞ্জ হলেও, হাজারো হৃদয়ে এর পরিচিতি এখনো বিক্রমপুর নামেই। কেবল ভূগোলের সীমা নয়-বিক্রমপুর একটি ইতিহাস, একটি সংস্কৃতি, একটি আত্মপরিচয়ের নাম। আজকের প্রজন্মের কেউ কেউ হয়তো জানেই না, “মুন্সীগঞ্জ” নামে জেলা হওয়া সত্ত্বেও কেন এখনো এই অঞ্চলের মানুষ “আমি বিক্রমপুরের” বলে পরিচয় দেন। এই নামের পেছনে লুকিয়ে আছে এক সমৃদ্ধ অতীত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গল্প, যা আমাদের নতুন করে ভাবায়- আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি?
ঐতিহাসিক শিকড় বিক্রমপুরের নাম ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় গৌড়ের রাজা বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে। এটি ছিল একসময় সেন ও পাল রাজবংশের রাজধানী। পাল রাজারা যখন বাংলার বৌদ্ধ শাসন ও সংস্কৃতির বিস্তার করছিলেন, তখন বিক্রমপুর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র। বিখ্যাত চিন্তাবিদ অতীশ দীপঙ্কর এই অঞ্চলেরই সন্তান। তিনি বাংলার বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে তিব্বতে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং এক ধরনের সাংস্কৃতিক দূত হয়ে ওঠেন।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র
বিক্রমপুর যুগে যুগে শিক্ষিত, প্রজ্ঞাবান ও প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষ শিক্ষানুরাগী বলেই পরিচিত। ১৮০০ শতকের শেষে ও ১৯০০ শতকের শুরুতে এখানকার শিক্ষার হার ছিল অন্যান্য অনেক জেলার তুলনায় বেশি। এখানকার শিক্ষা-সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে তোলে একঝাঁক মানুষ, যারা পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
বিখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ জগদীশ চন্দ্র বসু, কবি আতাউর রহমান, রাজনীতিক চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, রাজনৈতিক চিন্তারও প্রভাব পেয়েছিল বিক্রমপুরের উদারপন্থী ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ ব্যবস্থা থেকে।
কৃষি ও জনপদের বৈচিত্র্য
পদ্মা নদীর পলি মাটি আর খাল-বিল ভরা এই অঞ্চল একসময় ধান, পাট ও নানা রকম শাক-সবজির জন্য বিখ্যাত ছিল। এখনো অনেক গ্রাম্য মেলা ও উৎসবে বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী পিঠা, হস্তশিল্প ও কৃষিপণ্য পাওয়া যায়। এখানকার মানুষ পরিশ্রমী ও আত্মমর্যাদাশীল।
বিক্রমপুর ও রাজনৈতিক ইতিহাস
ব্রিটিশ আমলে বিক্রমপুর অঞ্চলে অনেক বিপ্লবী সংগঠন ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। এখানকার মানুষ বরাবরই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই জেলার মানুষ গৌরবের সাথে অংশ নিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, লৌহজং, টঙ্গীবাড়ী, সিরাজদিখান অঞ্চলগুলোতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল।
নাম পরিবর্তন ও আত্মপরিচয়ের সংকট
১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বিক্রমপুরের নাম পরিবর্তন করে “মুন্সীগঞ্জ” করা হয়। তখন থেকেই শুরু হয় নাম নিয়ে বিতর্ক ও মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত। যদিও “মুন্সীগঞ্জ” নামেরও ইতিহাস রয়েছে- একসময় এটি ছিল ব্রিটিশদের নিয়োজিত জমিদার বা মুন্সীদের আবাসস্থল- তবু এই নাম মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকা বিক্রমপুর নামের আবেগকে প্রতিস্থাপন করতে পারেনি।
“আমরা মুন্সীগঞ্জের না, বিক্রমপুরের” -এই বাক্য যেন একটি আত্মপরিচয়ের ভাষ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে দেশের বাইরে থাকা প্রবাসীরা যখন নিজেদের পরিচয় দেন, তখনও বলেন “I’m from Bikrampur”.
বিক্রমপুর উৎসব ও সাংস্কৃতিক চেতনা
প্রতিবছর বিক্রমপুর উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে এখানকার মানুষ ঐতিহ্য ও শিকড়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। এই উৎসবে পাওয়া যায় পল্লীগীতি, নৃত্য, বাউল সংগীত, কবিতা পাঠসহ নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, যা প্রমাণ করে – বিক্রমপুর কেবল একটি স্থান নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক জীবনধারা।
বিক্রমপুর আজ ও আগামীকাল
বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলা দেশজুড়ে স্বনামধন্য হলেও, বিক্রমপুর নামটি এখনো বেঁচে আছে লেখকদের কলমে, শিল্পীদের গানে, মানুষের মুখে মুখে। প্রযুক্তির এই যুগেও যদি আপনি মুন্সীগঞ্জ জেলার একজন প্রবীণ নাগরিককে জিজ্ঞেস করেন- “আপনি কোথাকার?”, তিনি বলবেন, “বিক্রমপুরের”। এই আবেগ, এই আত্মপরিচয় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- নাম একটি নিছক ট্যাগ নয়, নাম একটি ইতিহাসের প্রতীক, একটি আবেগের স্রোত।
বিক্রমপুরের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রশাসনিক কারণে নাম বদলালেও মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়া এই নামটিকে কখনোই ভুলে যাওয়া যায় না। আমাদের উচিত এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা। বিক্রমপুরকে শুধু স্মৃতিতে নয়; গবেষণা, সাহিত্য ও সমাজচিন্তায় আরো বেশি করে জাগিয়ে তোলা। বিক্রমপুর হারায়নি; বরং জীবন্ত হয়ে আছে আমাদের চেতনায়।