বিশেষ প্রতিবেদক
দেশে করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় সরকারি-বেসরকারি ৭টি ল্যাবকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) থেকে ওসব ল্যাবে কোনো নমুনা পাঠানো হচ্ছে না। এমনকি ওসব প্রতিষ্ঠানকে সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা সংগ্রহেরও অনুমতিও দেয়া হচ্ছে না। আবার নমুনা সংগ্রহে কেন্দ্রীয়ভাবে পুলও তৈরি করা হচ্ছে না। ফলে আগের মতোই শুধু ঢাকায় দুটি ও চট্টগ্রামে একটি ল্যাবে চলছে পরীক্ষা। কিন্তু প্রস্তুত ৭টি ল্যাব নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে। মূলত করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে আইইডিসিআরের একক কর্তৃত্বের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ১০টি ল্যাব করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আরো ১৯টি ল্যাব স্থাপনের কাজ চলছে। ১৫ এপ্রিলের মধ্যেই সেগুলো কাজ শুরুর মতো অবস্থায় যাবে। তাছাড়া স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাব ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল থাকা সত্ত্বেও করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কার্যক্রমে সরকারি প্রতিষ্ঠান নিপসমকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। অথচ সেক্ষেত্রে আইসিডিডিআর, বি-কে নামমাত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। আর ওসব কারণে করোনাভাইরাসের পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাস এখন একটি বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বে এই মহামারী মোকাবেলায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে দেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনকে (নিপসম) অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ নিপসম থেকে প্রতি বছর দেড়শ’জনের বেশি শিক্ষার্থী জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে এমপিএইচ ও এমফিল ডিগ্রি অর্জন করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞে পরিণত হচ্ছেন। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতিতে তাদের কাজে লাগানোর কোনো ব্যবস্থা এখনো করা যায়নি। অথচ কোভিড-১৯-এর মতো জুনোটিক (প্রাণীবাহিত রোগ) রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই জরুরি। তাছাড়া নিপসমে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাব রয়েছে। শুধু বায়োসেফটি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই ল্যাবেই করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব। তাছাড়া নিপসমের রয়েছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল। কিন্তু আইইডিসিআরের পাশেই অবস্থিত ওই প্রতিষ্ঠানকে কেন কাজে লাগানো হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সূত্র আরো জানায়, সারা দেশে বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে টিম গঠন করে সব সন্দেহভাজনের নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পুল তৈরি করা না হলে পর্যাপ্ত নমুনা পাওয়া যাবে না। ফলে আশানুরূপ পরীক্ষা করাও সম্ভব হবে না।
এদিকে রাজধানীর কুর্মিটোলা করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন এমন তিন থেকে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাদের পরীক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও আইইডিসিআর থেকে নমুনা সংগ্রহে কাউকে পাঠানো হয়নি। ফলে ওই রোগীরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ছিলেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাতে হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্সদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তার আগে সন্দেহভাজন এক রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে রাজধানীর ডেল্টা হাসপাতালের প্রায় ১০ জন চিকিৎসক ও নার্স কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হন। পরে ওই হাসপাতালের সব কর্মীকে কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়। অথচ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর’বি) গবেষণাগারে আটটি পিসিআর মেশিন রয়েছে। তাছাড়া নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার জন্যও রয়েছে উচ্চ প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সব গবেষণা পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ওই ল্যাব ও জনগোষ্ঠী কাজে লাগাতে আইইডিসিআর অনীহা প্রকাশ করেছে। আর শেষ পর্যন্ত ল্যাব কাজে লাগানোর কথা বলা হলেও নিজস্ব ব্যবস্থায় নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার অনুমতি মেলেনি। এমনকি আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে মাত্র ১০০টি করোনা পরীক্ষার কিট দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাসে সন্দেহভাজন সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকেও একাধিকবার অধিকতর পরীক্ষা করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সামগ্রিক বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে সরকারের পক্ষ থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৯টি ল্যাব স্থাপনের কাজ চলছে। সেক্ষেত্রে সমন্বিত পুল করে নমুনা সংগ্রহে ব্যাপক জনবল অন্তর্ভুক্ত করা না হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কারণ সন্দেহভাজন অনেকেই পরীক্ষার বাইরেই থেকে যাবে।