নিজস্ব প্রতিবেদক
সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) স্থাপন করায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। সড়ক থেকে বর্জ্য ও কনটেইনার ঢুকছে এসটিএসে। অনেকটাই বন্ধ হয়েছে রাস্তাঘাটে গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলা। ফলে গতি বাড়ছে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রমে। তবে এসটিএস স্থাপনে পিছিয়ে আছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। দক্ষিণে ৪২টি থাকলেও উত্তর সিটি করপোরেশনে এসটিএস ৫৪টি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এমন ৯২টি এসটিএস নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে ডিএনসিসিতে এসটিএস ৫৪টি। এসব এসটিএসে নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, ২০১৬ সালে সালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এসটিএস স্থাপনে উদ্যোগ নেন ডিএনসিসির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। পরে ডিএসসিসির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন একই উদ্যোগ নেন। তবে জায়গা সংকটের কারণে পর্যাপ্ত এসটিএস স্থাপনে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে ডিএসসিসি। বিশেষ করে পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় এসটিএস স্থাপনের মতো তেমন জায়গা নেই। এসটিএস বর্জ্য ব্যস্থাপনার অনেকগুলো ধাপের মধ্যে একটি বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। তিনি বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এসটিএস স্থাপন একটি ‘টেম্পোরারি’ সমাধান। বর্জ্য সম্পদে রূপ দিতে হলে সিটি করপোরেশনগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। গৃহস্থালি থেকে বর্জ্য সরাসরি অপসারণ করতে হবে ভাগাড়ে। তিনি বলেন, আগে রাস্তাঘাটে বর্জ্য ও কনটেইনার পড়ে থাকতো। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এসটিএসের ভেতর সেই বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। প্লাস্টিক, পলিথিন সংগ্রহে বর্জ্য ঘাটছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এতে চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়ায়। অনেক সময় বর্জ্যের ময়লার পানি গড়িয়ে রাস্তায় চলে আসছে। এজন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) এখন ৫৪টি ওয়ার্ড। এর মধ্যে উত্তরায় ১ নম্বর ওয়ার্ডের বিডিআর বাজার, সেকশন-১২, সেকশন-১০ এর রানাভোলা, মিরপুরে-২ নম্বর ওয়ার্ডের সিরামিক রোড, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের জল্লাদখানা, ডিএনসিসি মার্কেট, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাইশটেকি কালভার্ট, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কালশী রোড, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আরামবাগ কালভার্ট, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের শিয়ালবাগী মোড় ও প্রশিকা অফিস, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের রাইনখোলা, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের গাবতলীর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের দিয়াবাড়ী মাজার রোড ও ১০ নম্বর কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের টোলারবাগ, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আগারগাঁও তালতলা বাসস্ট্যান্ড, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভাসানটেক বাজার ও মানিকদি, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কচুক্ষেত ওয়াসা পাম্প, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কুড়িল বিশ্বরোড, নিকুঞ্জ-২ ও নিকেতনে এসটিএস নির্মাণ করা হয়েছে। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের খিলক্ষেত রেলগেটে আরেকটি এসটিএস নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু রেললাইন সম্প্রসারণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজের কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন পাশেই ফাঁকা জায়গায় আবার এই এসটিএস স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ এলাকার মানুষের চাহিদার কথা বিবেচনা করেই এসটিএস স্থাপন করা হয়েছিল। স্থাপনের পর এটি স্থানীয়রা ব্যবহারও করেছিলেন। এখন নতুন করে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন বাজার, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কড়াইলের টিঅ্যান্ডটি মাঠ, গুলশান শুটিং ক্লাব, বনানী বিটিসিএল অফিস, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মহাখালী কাঁচাবাজার, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাড্ডার গুদারাঘাট, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বনশ্রী, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের খিলগাঁও (কবরস্থান), ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের তেজগাঁওয়ের অরিয়ন মোড়, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের তেজগাঁও রোলিং মিল সংলগ্ন, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের তেজকুনীপাড়া খেলার মাঠ, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে খেজুর বাগান ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের পঙ্গু হাসপাতাল ও আগারগাঁও বিজ্ঞান জাদুঘর, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের রিং রোড, ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ঢাকা উদ্যান, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদপুর টাউন হল, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদপুরের ফারটিলিটি ও পিজিআর (গণবভনের বিপরীতে), ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বসিলা সেতু ও জাকের ডেইরি ফার্ম, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের মগবাজারের ইস্কাটন রোড, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের মগবাজার বিটিসিএল অফিস, ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের আফতাবনগরের ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড এলাকায় এসটিএস স্থাপন করা হয়েছে। বসিলা সড়ক সম্প্রসারণ করায় বসিলা সেতু সংলগ্ন এসটিএসটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। হাতিরঝিল থেকে গুলশান-১ এ ঢুকতে অর্থাৎ গুলশান শুটিং ক্লাবের দক্ষিণ কোণে দুই বছর আগে স্থাপন করা হয়েছে বড় একটি এসটিএস। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, চারপাশে প্রায় ১৫ ফুট উঁচু কংক্রিটের দেয়াল। এর উপর স্টিলের কাঠামোর ছাউনি। পূর্ব পাশে বড় ময়লার গাড়ি ঢোকার জন্য দরজা রাখা। গুলশানের বিভিন্ন সড়কের বাসাবাড়ি থেকে ভ্যানে বর্জ্য আনছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এসব ভ্যানের বর্জ্য তারা এসটিএসের ভেতর রেখে আবার বর্জ্য সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন। গুলশান-১ আবাসিক এলাকা থেকে চার বছর ধরে বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ করেন জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, আগে বর্জ্য সংগ্রহ করার পর তা গুলশান শুটিং ক্লাবের ওই জায়গায় স্তূপ করে রাখা হতো। এতে চারপাশে ময়লা ছড়িয়ে যেত। দুর্গন্ধের কারণে মানুষ প্রায়ই ডিএনসিসিতে অভিযোগ দিতো। এখন এসটিএস থাকায় সে সমস্যা নেই। রাস্তা থেকে বর্জ্য দেখাও যায় না। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ঢাকার চারপাশের ১৬টি ইউনিয়নকে ৩৬টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এর মধ্যে বাড্ডা, ভাটারা, সাঁতারকুল, বেরাঈদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও হরিরামপুর ইউনিয়নকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। এই ওয়ার্ডগুলোতে এখনো এসটিএস নির্মাণ করেনি ডিএনসিসি। ডিএনসিসির ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আনিছুর রহমান নাঈম বলেন, আমার ওয়ার্ডে দুটি এসটিএস নির্মাণের কথা। কিন্তু এখনো জায়গা নির্ধারণ করতে পারেনি ডিএনসিসি। অথচ গৃহস্থালির বর্জ্য যে যার মতো রাস্তাঘাটে ফেলছে। অন্যদিকে জনগণের কাছেও জবাবদিহি করতে হচ্ছে। তবে এই ওয়ার্ডগুলোতে এসটিএস নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ডিএনসিসির নতুন ওয়ার্ডগুলোর আয়তন অনেক বড়। তাই প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে দুটি করে এসটিএস দরকার। এখন ডিএনসিসি এসটিএস স্থাপনে জায়গা দেখছে। জায়গা পেলে তা একেক করে নির্মাণ করা হবে। ‘আগের ওয়ার্ডগুলোতে এসটিএস স্থাপন করার পর বর্জ্য অপসারণে গাড়ি বেড়েছে। এখন বর্জ্যকে সম্পদে রূপ দিতে আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন কাজ চলছে। এসটিএস থেকে বর্জ্য এই কেন্দ্রে যাবে। সেখানে বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) নতুন-পুরোনো মিলে ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে মানিকনগর, কমলাপুরের টিটিপাড়া, পান্থকুঞ্জ পার্ক, কলাবাগান, মুক্তাঙ্গন ও আনন্দবাজার, হাজারীবাগ, পলাশী, বাবুবাজার, সিক্কাটুলী, তাঁতীবাজার মোড়, কাপ্তানবাজার, সায়েদাবাদ, টিকাটুলি, ওয়ারি, ধোলাইখাল, নারিন্দা, লোহারপুল, যাত্রাবাড়ী কলাপট্টি, গোলাপবাগ, দয়াগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী মোড়, জুরাইন ওয়াসা রোড, জুরাইন কবরস্থান রোড, কামরাঙ্গীরচরের ব্যাটারিঘাট, মান্ডাসহ ৪২টি ওয়ার্ডে এসটিএস স্থাপন শেষ করেছে ডিএসসিসি। বংশালের সিক্কাটুলী এলাকাটি ডিএসসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। সরেজমিনে দেখা যায়, এই ওয়ার্ডের সিক্কাটুলী পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে রাস্তার এক কোণে প্রায় ৫০০ বর্গফুট আয়তনের জায়গার ওপর একটি এসটিএস স্থাপন করা হয়েছে। তবে ভেতরে ময়লা-আবর্জনা দেখা যায়নি। শুধু বর্জ্য সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত কয়েকটি ভ্যান দেখা গেছে। স্থানীয় কাউন্সিলর আউয়াল হোসেন বলেন, আগে এই এসটিএসের জায়গায় তিনটি কনটেইনার রাখা হতো। মহল্লার লোকজন যে যার মতো করে বর্জ্য সেখানে ফেলতো। এতে বর্জ্য গড়িয়ে রাস্তা ও পুকুরে গিয়ে পড়তো। এসটিএস স্থাপনের পর এ অব্যবস্থাপনা বন্ধ হয়েছে। এখন প্রতিদিন বিকেলে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। রাতে সেই বর্জ্য ট্রাকে ল্যান্ডফিলে নেওয়া হয়। পরে এসটিএসের ভেতর পানি নিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়। এতে দুর্গন্ধ ছড়ায় না। ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, এখন ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদনীঘাট, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের আইজিগেট, ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব জুরাইন, ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের দনিয়া কলেজের বিপরীতে, ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের হাসেম রোড, ৭৬ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব বক্সনগর, ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের সারুলিয়া বাজার, ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের কায়েতপাড়া, ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে নাসিরাবাদ এলাকায় আলাদা এসটিএসের নির্মাণকাজ চলছে। এর মধ্যে ৩৭, ৫২, ৬০, ৬৬ ও ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। এই এলাকাগুলো এসটিএস নির্মাণে ডিএসসিসির পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ১০, ১১, ৩১, ৪৫, ৫৯, ৬১, ৬৯ ও ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে জায়গা নির্ধারণের কাজ চলছে। ৩৪, ৫৫, ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে এসটিএসের নকশা অনুমোদন হয়েছে। ২৭ ও ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায়। জানতে চাইলে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে এসটিএস নির্মাণে কাজ করছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এখন যেসব ওয়ার্ডে এসটিএস নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেকটাই শৃঙ্খলা এসেছে। আশা করি বাকি ওয়ার্ডগুলোতে দ্রুত সময়ের মধ্যে এসটিএস নির্মাণ করা যাবে।