নিজস্ব প্রতিবেদক
মাটির তৈরি মাইট বা মটকি একসময়ের বহুল ব্যবহৃত খাদ্যদ্রব্য বা প্রয়োজনীয় দ্রব্য রাখার পাত্র হিসেবে ব্যবহার হতো। সবার বাড়িতেই কমপক্ষে ১ থেকে ২টা মটকি থাকত। কালের বিবর্তনে এই মাইট মটকি এখন খুব একটা দেখা যায়না। গ্রামাঞ্চলের ভাষায় এই পাত্রকে মাইট বা মটকি বলে থাকেন। মাটি থেকে তৈরি করা একপ্রকার বিশালাকৃতির পাত্র, যা দেখতে অনেকটা কলসের মতো মনে হয়। এ জাতীয় পাত্রে সাধারণত চাল সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণের পর্যবেক্ষণজাত সত্য হচ্ছে, মটকায় রাখা চালে সহজে পোকা ধরে না এবং চালের গন্ধ ও স্বাদ দীর্ঘদিন অটুট থাকে। তাছাড়া মাটি থেকে তৈরি বলে এ জাতীয় পাত্রের সংস্পর্শে থাকার ফলেও চালে কোনো ক্ষতিকারক উপাদান মিশে না। মটকি তৈরি কুমার শিল্পের কারিগরের তথ্যে জানা যায়, প্রথমে নরম এঁটেল দোআঁশ মাটি সংগ্রহ করা হয় সাধারণত ধানী জমি কিংবা নদীর গর্ভ থেকে। সেই মাটিকে ভালোমতো দলিতমথিত করে জমিয়ে রাখা হয় এক স্থানে। তারপর সেখান থেকে মাটির হালকা একটা স্তর এনে একটা কড়াই আকৃতির জিনিসে মাটির স্তরটি বসিয়ে মটকার তলা বানানো হয়। তারপর সেই তলার পাশ দিয়ে আরো স্তর যোগ করে মটকার কিনারা তৈরি করা হয়। অনেক সময় আগে থেকে তৈরি করা রিং পরিয়ে দেয়া হয স্তরে স্তরে। এসময় আগের স্তরের সাথে নতুন স্তরকে আটকে দেবার জন্য ভেজা কাপড় দিয়ে জোড়াগুলোকে ভিজিয়ে পলিশ করে নেয়া হয়। কখনও কখনও সামান্য গোলাকৃতি কোনো বস্তু দিয়ে ভিতর থেকে চাপ দিয়ে মটকার গোলাকৃতি বজায় রাখা হয়। সবশেষে কলসের মতো গলার অংশের একটা স্তর যোগ করা হয়। সাধারণত কলস যেভাবে চাকার উপর রেখে বানানো হয়, মটকার বিশাল আকৃতির কারণে সেভাবে বানানো সম্ভব হয় না। মাটির তৈরি মটকা এরপর রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। পুড়িয়ে নেয়ার আগে মাটি খোদাই করে কিংবা পুড়িয়ে নেয়ার পরে রং দিয়ে অনেক সময় মটকায় নকশাও করা হতো। সাধারণত নকশায় গ্রাম্য মোটিভ ফুটে ওঠে। হিন্দু পরিবারগুলোতে মটকার মধ্যে বিভিন্ন মাঙ্গলিক চিহ্ন আঁকার প্রচলনও দেখা যায়। বায়ু প্রতিরোধী হিসাবে কৃষিপণ্য সংরক্ষণে এটি একটি অন্যতম জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত পাত্র ছিল। মুন্সীগঞ্জের গ্রামগুলোতে সাধারণত বছরে একবার মাত্র ধান থেকে চাল করে সারা বছরের জন্য সংরক্ষণে এসব মটকা বা বাঁশের বেত দিয়ে তৈরী বড় বড় ‘গোলা’ ব্যবহার করা হত। অনেকদিন ব্যবহার করা যেত। এতে ধান, চালে পোকামাকড়ের আক্রমণ হতো না। ৯০ দশকে গৃহস্থের বাড়িতে এরকম অনেক বড় বড় মটকা ও গোলা ছিল। ওই সময় গৃহস্থরা এখনকার মত ধান চাল বিক্রি করতো না। ফসল উৎপাদন ছিল কম। বর্তমান সময়ে নানা ধরনের ফসল উৎপাদন হচ্ছে। গৃহস্থরা উৎপাদিত ফসল মাঠ থেকে ঘরে না তুলেই বাড়ির বাইরে থেকেই ব্যবসায়ীদের ঘরে দিয়ে আসছে। ফলে এখন ধান সংরক্ষণের জন্য ওইসব গোলা বা মটকি ব্যবহার গৃহস্থদের তেমন প্রয়োজন হচ্ছে না। তাছাড়াও এখন ইটের তৈরি বাড়িঘরের সংখ্যা বেড়েছে। শহরের মত করে গ্রামগঞ্জেও তৈরি করা হচ্ছে বাড়িঘর। ওইসব বাড়িঘরে গৃহস্থরা খাবার জন্য শুধু চাল সংরক্ষণ করে থাকে। সেটাও করে থাকে লোহার বা প্লাস্টিকের তৈরি ড্রামে। কালের বিবর্তনে বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন ঘটায় এবং ফসল উৎপাদনের ধরনের পরিবর্তন হওয়ায় সেগুলোর ব্যবহার না থাকায় প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব এ মটকি এখন বিলুপ্তপ্রায়।