লাইফস্টাইল ডেস্ক
সারা বিশ্বে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে। রমজান মাসে রোজা রাখা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। সারাদিন রোজা রেখে নবীজি (স.) ইফতার শুরু করতেন খেজুর দিয়ে। তাঁর অনুসারীরা যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করে আসছেন তাঁকে।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ফল খেজুর। সংস্কৃত খর্জুর থেকে বাংলা খেজুর। যার বৈজ্ঞানিক নাম ফিনিক্স ড্যাকটিলিফেরা। তালজাতীয় শাখাবিহীন খেজুর গাছ প্রধানতঃ মরু এলাকায় ভাল জন্মে। পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকা দেশগুলোতে খেজুরের চাষ প্রচলন বেশি। অনেকের মতে ইরাক অথবা মিসর খেজুর ফলের আদি স্থান। প্রাচীনকাল থেকে খেজুর ফলের বাগান সৃষ্টি করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত খাদ্য ও ফলের উৎস হিসেবে খেজুর মানুষের জীবন ধারণের অন্যতম অবলম্বন ছিল।
আরব দেশগুলোর মরুভূমি এলাকায় যেখানে অন্য কোনো গাছপালা জন্মানো সহজ হয় না সেখানে খেজুর বাগান সৃষ্টি করে মরুদ্যান সৃষ্টি করা হতো। খেজুর যেসব দেশে বেশি চাষ হয় তার মধ্যে মিসর, সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, ওমান, লিবিয়া ও তিউনেশিয়া অন্যতম। চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও আমেরিকার কিছু অংশে সফলভাবে খেজুর চাষ করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে খেজুর গাছ “ট্রি অফ লাইফ” বা জীবন বৃক্ষ নামে পরিচিত। খেজুর উৎপাদনে বিশ্বে সৌদি আরবের অবস্থান তৃতীয়। সমগ্র সৌদিআরবে ৩৬০ প্রজাতির প্রায় আড়াই কোটি খেজুর গাছ আছে। আকারে ও স্বাদে খেজুর অনেক প্রকারের হয়। উল্লেখযোগ্য হলো – পাঠান-আল মদিনা, মাসকানি, বার্হী, শাহীবি, খালস, আজওয়া, আনবারা, সাগি, সাফাওয়ি, ওয়ান্নাহ, সেফরি, খুদরি বেরহি, সামরান, জাহেদি, মরিয়ম, আনবারাহ, আসমাউল হাসনা, ইয়াবনি ইত্যাদি।
চারটি পর্যায়ে খেজুর পাকানো বা সংরক্ষণ করা হয়। আরবিতে সেগুলো কিমরি (কাঁচা), খালাল (পূর্ণাঙ্গ), রুতাব (পাকা নরম) এবং তুমুর (পাকা রোদে শুকানো)। খেজুর সাফাওয়ি নরম হয়ে থাকে। রং গাঢ় বাদামি। আকারে লম্বাটে। খেতে মাঝারি মিষ্টি। মদিনার বিখ্যাত খেজুর আমবার। এটি কম মিষ্টি। আর মরিয়ম নামের খেজুর লালচে বাদামি রঙের হয়। আকারে হয় এক-দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা। বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেজুর হলো আজওয়া। এর মধ্যেও আবার অনেক পদ আছে। সৌদি আরব থেকে আসে এই আজওয়া খেজুর। মদিনায় এ খেজুরের ফলন হয় বেশি। আজওয়া খেজুর কালো ও মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে। পুষ্টি ও মানের দিক দিয়ে সবচেয়ে ভালো খেজুরগুলোর মধ্যে আজওয়া রয়েছে প্রথম সারিতে। আজওয়া খেজুর নরম ও অনেক সুস্বাদু হয়। এগুলো আকারে ছোট ও উপরে সাদা রেখা দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই আপনাকে সঠিক আজওয়া খেজুর বাছাই করতে সাহায্য করবে। মেডজুল নামক খেজুর যা ‘খেজুরের রাজা’ হিসাবেও পরিচিত। এটি এখন দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেজুর বাগানটির অবস্থান কিন্তু সৌদি আরবে। নাম-আল-রাজেহী বাগান। সৌদি আরবের আল-কাসীম শহরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেজুর বাগান অবস্থিত। সাড়ে ৫ হাজার হেক্টরের এই বাগানটি প্রায় ২ লক্ষ খেজুর গাছ আছে। এখানে প্রায় ৪৫ রকম খেজুরের ফলন হয়। ২০১১ সালে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছে এই বাগান। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই বাগানের পুরো উৎপাদনই আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দেয়া হয়েছে। রমজানে মক্কা ও মদীনায় ইফতারির সমস্ত খেজুর এই বাগান থেকেই সরবরাহ করা হয়।
খেজুর পটাশিয়াম ও কপারসহ আরো পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, হাড়ের গঠন দৃঢ় করে। হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক। ক্যানসার নিরাময়ের গুণও আছে এর। এছাড়া এটি কর্মশক্তি বৃদ্ধি করে, স্নায়বিক দুর্বলতা দূর করে। পুষ্টিবিদদের মতে, খেজুরে থাকে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালোরি, সোডিয়াম, আয়রনসহ আরো অনেক খাদ্য উপাদান। এছাড়া খেজুরে রয়েছে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা। রোজ খেজুর খেতে পারেন। খেজুর একজন সুস্থ মানুষের শরীরে আয়রনের চাহিদার প্রায় ১১ ভাগই পূরণ করে।
পুষ্টিবিদদের মতে, ডায়াবেটিস থাকলে চলতি খেজুরের বদলে শুকনো খেজুরকে ডায়েটে রাখা যেতে পারে। শরীরের প্রয়োজনীয় আয়রনের অনেকটাই খেজুর থেকে আসে। খেজুরে রয়েছে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, আঁশ, পটাশিয়াম, জিঙ্ক ও আয়রন।
খেজুরের পুষ্টিগুণ, খেজুর শক্তির একটি ভালো উৎস। তাই খেজুর খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের ক্লান্তিভাব দূর হয়। খেজুরের পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে বলা হয় চারটি বা ৩০ গ্রাম পরিমাণ খেজুরে আছে ৯০ ক্যালোরি, এক গ্রাম প্রোটিন, ১৩ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম, ২.৮ গ্রাম ফাইবার এবং আরও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। সুস্বাদু আর বেশ পরিচিত একটি ফল, যা ফ্রুকটোজ ও গ্লাইসেমিক সমৃদ্ধ। আছে প্রচুর ভিটামিন বি, যা ভিটামিন বিসিক্স মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায়। খেজুর ফলকে চিনির বিকল্প হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। যেকোনও বয়সে রক্তাল্পতা দূর করতে খেজুরের জুড়ি মেলা ভার। বহু যুগ ধরেই কার্যকরী ল্যাক্সাটিভ হিসেবে খেজুর ব্যবহার করা হয়। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা ছাড়াও বদহজম, অ্যাসিডিটি এমনকি পাকস্থলির আলসারেও উপশম আনে খেজুর।
রক্তে খারাপ কোলেস্টোরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের আশঙ্কা কমায়। এছাড়া সোডিয়ামের মাত্রা (একশো গ্রামে মাত্র ২ মিলিগ্রাম) কম থাকায় এবং পটাশিয়ামের মাত্রা (প্রতি একশো গ্রামে ৬৫৬ মিলিগ্রাম) বেশি থাকায় হৃদযন্ত্রের পেশির সক্রিয়তা বাড়িয়ে তোলে খেজুর। পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, তামা, ভিটামিন-কে, এসেনসিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিড থাকায় নিয়মিত খেজুর খেলে বোন মেটাবলিজম ঠিক থাকে। অস্টিওপোরোসিসের আশঙ্কা কম থাকে। জৈব সালফার থাকার কারণে বিভিন্ন ভাইরাল, ফাঙ্গাল, ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণ দূর করে খেজুর। বিভিন্ন ফুসফুসের সংক্রমণও মোকাবিলা করতে সাহায্য করে খেজুর। যৌন অক্ষমতা এবং সন্তানহীনতার সমস্যা কাটাতে সাহায্য করে খেজুর। যারা সারাদিন শুধু খাই খাই রোগে ভোগেন, একসঙ্গে বেশি খাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমে যায় নিয়মিত খেজুর খেলে। বাড়ন্ত বাচ্চা, গর্ভবতী মহিলা, কিশোর-কিশোরীদের খাবারে শক্তির জোগান দিতে খেজুরের বিকল্প নেই। অনিদ্রার সমস্যা দূর করে খেজুর। মাইগ্রেন এবং মেনস্ট্রুয়াল ব্যথা কমিয়ে দেয়। প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকায় দাঁতের রোগে উপকার করে খেজুর। নাইট ব্লাইন্ডনেস বা রাত্রিকালীন অন্ধত্বের সমস্যা মেটায়।
রোজ খাদ্যতালিকায় খেজুর রাখতে পারেন। আয়রনে ভরপুর প্রতিদিন খেজুর খেতে পারেন। কমপক্ষে প্রতিদিন দুটি খেজুর খান, তবে অনেক রোগ কাছেও আসবে না।