নিজস্ব প্রতিবেদক
আলো-আঁধারে অবৈধভাবে প্রকাশ্যে ফসলি জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে প্রভাবশালী মহল। চলছে ফসলী জমির মাটিকাটা উৎসব। তিন ফসলী কৃষি জমি পরিণত হচ্ছে পুকুর-ডোবায়। দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমছে, বেকার হচ্ছে কৃষক, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত। মাটি পরিবহনে ভারী ট্রাক ও মাহেন্দ্র ট্রলি ব্যবহারে ইউনিয়ন ও গ্রামীণ সড়ক হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ। আইন অমান্য করে এমনি কর্মকান্ড চলছে মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। উপজেলার লতব্দী ইউনিয়নে ৬ টা ভেকু দিয়ে এ মাটি কাটছে। অবৈধ মাহেন্দ্র চলাচলে ধুলার কুয়াশায় ঢেকে গেছে গোটা এলাকা দেখার কেউ নেই। এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার প্রশাসক বরাবর আওলাদ হোসেন নামক এক মুক্তিযোদ্ধা অবৈধ মাটি কাটা বন্ধের জন্য লিখিত অভিযোগ করলেও কোন লাভ হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার কংশপুরা গ্রাম থেকে নয়াগাঁও বাজার হয়ে পাথর ঘাটা পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তা ধুলার কুয়াশায় ঢেকে গেছে। এই রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার মাটির ট্রাক ও অবৈধ মাহেন্দ্র চলাচল করে। এলাকা ধুলা-বালুতে আচ্ছন্ন হয়, এতে করে যাতায়াতে নানা শ্রেণির মানুষের শ^াসকষ্টসহ নানা রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে জনমনে ক্ষোভ। এ অবস্থায় দিশেহারা ও অসহায় জীবনযাপনসহ স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। এ ধুলার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ও শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে বেশী। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতির হার কমেছে ৪০ শতাংশ।
উপজেলা প্রশাসনিক দপ্তর থেকে মাত্র ২ কিলোমিটারের মধ্যে ভোর ৫টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে অবৈধভাবে ফসলি জমির মাটি কাটছে। দেখলে মনে হয়, সরকার থেকে অনুমতি নিয়ে পুকুর খনন করছে। উপজেলার লতব্দী ইউনিয়নের চন্দ্রবর্ধী এলাকায় ২টি ভেকু দিয়ে মাটি মাটছে পূর্ব রামকৃষ্ণ নদী গ্রামের মৃত মো. রশিদের ছেলে আসাদ (৪৫)। তার সাথে জড়িত ওমর আলী (৫০), উসমান (৫০), সেন্টু মেম্বার, কয়রাখোলা গ্রামের আব্দুল কাশেমের ছেলে বরকত (২৮) এবং মো. সিদ্দিক মিয়ার ছেলে নূন হোসেন (৩৫)। রামকৃষ্ণ নদী এলাকায় ২টি ভেকু দিয়ে মাটি কাটছে রামকৃষ্ণ নদী গ্রামের মিজান (২৮)। তার সাথে জড়িত সেন্টু বেপারী, মো. শাহিন খান (৪২) এবং লতব্দী ইউনিয়নের ১ নং ইউপি সদস্য শাহ আলী মেম্বার (৫০)। ধলেশ^রী নদীর পাশে রামকৃষ্ণ নদী গ্রামের মৃত বজলুল রহমানের ছেলে শান্ত (৩৮) ভেকু দিয়ে মাটি কাটছে। রামানন্দ এলাকায় ইছামতি নদীর পাশে ২টি ভেকু দিয়ে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত মাটি কাটছে রামানন্দ গ্রামের মো. আব্দুল মালেক খন্দকারের ছেলে যুবলীগ নেতা কামরুজ্জামান খন্দকার মনির (৩৭)। তার সাথে জড়িত ভাষানচর গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে মো. মোক্তার হোসেন (৪৫) ও একই গ্রামের কাদির (৫৭)। কোন সংবাদকর্মী সংবাদ সংগ্রহে যেতে পারে না। ভূমিদস্যুদের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী কেউ গেলে তাদেরকে প্রতিহত করে। এই সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে রাস্তা থেকেই ঘিরে ফেলে ভূমিদস্যুসহ তাদের সহযোগীরা।
নয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শ্রেণীর ছাত্র সোহান, রেদোয়ান ও সাদিয়া বলেন, আমরা স্কুলে আসতে পারিনা। ধুলায় আমাদের জামাকাপড় নষ্ট হয়ে যায়। মাহেন্দ্রার ধুলার কারণে বাড়িতে পড়তে পারিনা, ভাত খাইতে পারিনা, দিনে জানালা খুলে পড়তে পারিনা। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি।
নয়াগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ননী গোপাল মন্ডল বলেন, ধুলা-বালির কারণে অনেক অসুবিধায় আছি। আমাদের অনেক শিশুর সর্দি লেগে আছে। ধুলার পরিমান এতোই যা চলার মতো না। শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে পারছে না। কর্তৃপক্ষ কিছুই দেখছে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলায় বৈধ ও অবৈধ ইটভাটা মিলে প্রায় ৫০টি ইটভাটার মধ্যে মোট ইট উৎপাদন হয় প্রায় ১ শত ৫০ কোটি। উৎপাদিত ইটের কাঁচামাল হিসেবে প্রায় ৭০ শতাংশ মাটি যায় লতব্দী ও বাসাইল ইউনিয়নের বিভিন্ন ফসলি জমি থেকে। শুধু লতব্দী ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ট্রলি অবৈধভাবে ফসলি জমির মাটিকাটা হচ্ছে। এসব মাটি প্রায় ৬০ লাখ টাকা বিক্রয় হচ্ছে ইটভাটাগুলোতে। প্রতি ফুট মাটি ১৩ থেকে ১৬ টাকা বিক্রয় করা হয়। দীর্ঘদিন যাবত চলছে এ মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ। স্থানীয় প্রশাসন ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা জড়িত রয়েছে।
এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগী জমির মালিকগণ জানান, উপজেলার লতব্দী ইউনিয়নের খিদিরপুর ও রামকৃষ্ণদী মৌজায় ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে ইটভাটায়। ভূমিদস্যুরা জমির মাটি ভেকু মেশিন দিয়ে ১০/১২ ফুট গভীর করে খাড়াভাবে কাটে, যাতে করে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে পার্শ্ববর্তী জমির মাটি ভেঙে পড়ে যায়। গুয়াখোলা গ্রামের ভুক্তভোগী আলী হোসেন জানান, আমার পাশের জমিতে মাটি কাটার ফলে আমার জমির পাড় ভেঙ্গে যায়। জমিতে সেচের পানি আটকে রাখা যাচ্ছেনা। তাই জমিতে ফসল ফলানো যাবেনা। বিষয়টি আমি উপজেলা প্রশাসনকে পূর্বেই অবহিত করেছি, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আবার মাটি ভর্তি ট্রাক ও ট্রলিগুলো নেয়া হচ্ছে গ্রামীন ও ইউনিয়ন সড়ক দিয়ে। ফলে রাস্তাগুলোতে উঁচু-নিচু এবং বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। এলাকা ধুলা-বালুতে আচ্ছন্ন হয়, এতে করে যাতায়াতে নানা শ্রেণির মানুষের শ^াসকষ্টসহ নানা রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে জনমনে ক্ষোভ। এ অবস্থায় দিশেহারা ও অসহায় জীবনযাপন করছে ভুক্তভোগী জমির মালিক ও এলাকাবাসী।
সরকারী গেজেটে প্রকাশিত মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসকরণ ২০১৩ সালের ৫৯ নং আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি ইট প্র¯ুÍত করার উদ্দেশ্যে কৃষি জমি হতে মাটি কাটা বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। যদি কোন ব্যক্তি আইনের এই ধারা লঙ্ঘন করেন তাহলে তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসরের কারাদন্ড বা ২ (দুই) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত বা ইউনিয়ন বা গ্রামীন সড়ক ব্যবহার করিয়া কোন ব্যক্তি ভারি যানবাহন দ্বারা ইট বা ইটের কাঁচামাল পরিবহন করিতে পারিবেন না। যদি কোন ব্যক্তি আইনের এই ধারা লঙ্ঘন করেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন। এসব আইন থাকার পরও ভূমিদস্যুরা আইনের তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রশাসন চোখের সামনে এসব কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করার পরও প্রশাসনের এই নিরব ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এলাকাবাসীর মনে।
অবৈধ মাটি কাটায় লিপ্ত আসাদ জানান, এ বিষয়ে ফোনে কথা বলা যাবে না। সামনাসামনি কথা বলবো। সবাইতো আমার কথা বলে, আমিতো সামান্য মাটি কাটি। মিজান ও নূর হোসেন বেশী মাটি কাটে।
বরকতের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি ঢাকার বাহিরে আছি। এ বিষয়ে সামনাসামনি কথা বলবো। এ বলে ফোন রেখে দেয়।
ভেকুর মালিক মিজানের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি মিজান না বলে সাফ জানিয়ে ফোন কেটে দেয়।
লতব্দী ইউপির ১নং ওয়ার্ড সদস্য শাহ আলী মেম্বার জানান, আমি একটা ভেকু চালাইতাছি সঠিক তথ্য তো এটা না। একেকটা একেকজনের নামে চলে। এলাকায় গিয়া জিগাইবেন এই ভেকুটা কার? এটা মিজানের, এটা কার? এটা শান্তর, এটা কার? এ বরকতের? এটা কার? নূর হোসেনের, এটা অমুকের। আমি তো চালাই না। আমার তো কোন ভেকু নাই। পোলাপাইনে মনে করে আমার খোলায় মাটি দেয়। গিয়া কয় আমার লগে থাকবেন এই আর কি। আমার নামে কোন কাইট চলে না। গ্রামের অনেক লোক জড়িত। প্রকাশ্যে মাটি কাটার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি একলা জনপ্রতিনিধি বাধা দিমু? একলা আমি কি করমু? দেখা যায় ৫০ জন এটার সাথে জড়িত। আমার একই প্রশ্ন প্রকাশ্যে মাটি কেমনে কাটে? ধুলার জন্য আমি পানি দেয়ার ব্যবস্থা করেছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, কৃষক লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিবো।
সিরাজদিখান থানার ওসি মো. ফরিদ উদ্দিন জানান, ফসলি জমির মাটি কাটার বিষয়টি ব্যবস্থা নিবে প্রশাসন। মাটি কাটার বিষয়ে প্রশাসন সহযোগিতা চাইছে আমরা সবসময় প্র¯ুÍত। কেউ যদি অন্যের জমির মাটি জোর করে কাটে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। কিছুদিন আগে আমরা ৬টা মাটির গাড়ি আটক করেছিলাম কিন্তু প্রশাসন ভ্রাম্যমান আদালত করেনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশফিকুন নাহারের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।