নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা জেলার তিনটি উপজেলায় বিস্তৃত দেশের মধ্যাঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ বিল আড়িয়ল। ২৬ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ১০ মাইল প্রস্থের এই প্রাচীন জলাভূমির মোট আয়তন এক লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর। আশপাশের ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ৭০টি গ্রামের জীবনধারা নিয়েই ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে আড়িয়ল-সভ্যতা। আড়িয়ল বিল বর্ষা মৌসুমে পদ্মা নদীর প্রবাহিত প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও বিভিন্ন জাতের পাখির বিচরণ ক্ষেত্র হচ্ছে এ বিল। বিলে গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহ আর প্রখর রোদের পর ঘন গৌরবে নব যৌবনে আসে বর্ষা। ষড়ঋতুর লীলার মাঝে বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যে বর্ষাকাল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। বসন্তকে ঋতুরাজ বললেও রূপের গৌরব ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের জন্য বর্ষাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। আষাঢ় বা বর্ষা নিয়ে এমন অনেক গান বা কবিতাই রয়েছে কবিগুরুসহ সকল কবিদের। বর্ষা এমনই এক ঋতু। আষাঢ় ও শ্রাবণ এ দু’মাস বর্ষাকাল। বর্ষায় প্রকৃতিতে মহান স্রষ্টার অপরূপ সৌন্দর্যের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়। অঝোর ধারায় বৃষ্টিস্নাত হয়ে সবুজ গাছগাছালিতে সুন্দর হয়ে ওঠে আমাদের চারপাশ। বৃষ্টি আমাদের প্রকৃতিকে যেমন ফলে ফসলে ভরিয়ে দেয়, তেমনি আমাদের মন-মানসকেও স্পর্শ করে। বর্ষার দিনে টিনের চালে টাপুর টুপুর রিনিঝিনি বৃষ্টির ছন্দে উদাস হয় মন। বৃষ্টি ঝরে গ্রামে, হাটে, মাঠে, শহরে, নদীতে। তুমুল বৃষ্টিতে গাঁয়ের ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। পুকুর জলে টুপ টুপ ডুব দিয়ে আনন্দে খেলা করে হাঁসের ছানা, ডেকে ওঠে কোলাব্যাঙ। মাছেরা ছুটে বেড়ায় বৃষ্টির নতুন পানিতে। দুষ্টু ছেলেরা কলাগাছ কেটে ভেলা বানায়। কলার ভেলায় চড়ে আনন্দে মেতে ওঠে দুরন্ত কিশোরের দল। গ্রীষ্মের প্রচন্ত তাপদাহ শেষে শীতল বাতাস আর বৃষ্টির ধারা নিয়ে আসে। ক্লান্ত দেহে তখন প্রাণের সঞ্চার হয়। প্রকৃতিও তখন সেজে ওঠে নানান রুপে। প্রকৃতির এমন সৌন্দর্যে প্রকৃতিগতভাবেই আমাদেরও আশা জাগে একটু মানসিক প্রশান্তির। প্রকৃতির রানী বর্ষা। শিল্পরসিক মন বর্ষার বিচিত্রতায় অভিভূত হয়ে যায়। এক কথায় প্রকৃতিকে মন ভরে উপভোগ করতে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় বর্ষা। শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বর্ষাকে যেন একটু বেশি করে উপভোগ করে। বাংলাদেশ যে নদীমাতৃক দেশ এটা পূর্ণতা পায় বর্ষাকালে। বর্ষায় গ্রামগঞ্জের মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, জলাশয় ভরে ওঠে। ছেলেপুলেরা খেলাধুলায় মত্ত হয়ে ওঠে। গ্রামের পথ-ঘাট কাদাজলে মাখামাখি হয়ে যায়। কোথাও আবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে মানুষ। বৃষ্টিবিলাসে নববধূ, প্রেমিক-প্রেমিকার মন উদাস হয়ে ওঠে। শহুরে জীবনে বর্ষণমুখর দিনে জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও গ্রামের চেয়ে ভিন্ন। শহুরে জীবনে বর্ষা মশার উৎপাত বাড়িয়ে দেয়। ব্যস্ত জীবনের ছুটে চলা হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে বর্ষা ভিন্নমাত্রা যোগ করে। ভারী বর্ষণে নগরজীবনে জলাবদ্ধতা আর যানজটের সেই চিরচেনা দৃশ্য দেখা যায়। অনেকে বাড়ির ছাদে ওঠে বর্ষাকে উপভোগ করে। অনেক সময় ছেলেপুলেরা বৃষ্টিবিলাসে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। জানালার পাশে কোনো প্রেয়সী উদাস মনে ভাবে তার প্রিয় মানুষের কথা। অন্যভাবে চিন্তা করলে বর্ষণমুখর দিনে দিনমজুরের ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কাজ কমে যায়। বর্ষায় গ্রামগঞ্জের খাল-বিলে শাপলা ফুল ফুটে। কৃষক সেচ কাজের জন্য বর্ষার অপেক্ষায় থাকে। পালতোলা নৌকা হুতাশনের বেগে আপন মনে বয়ে যায়। ভরা যৌবন পাওয়া নদীতে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়। বর্ষায় প্রেমিকের হাতে ওঠে কদমগুচ্ছ। প্রেয়সীর খোঁপায় স্থান পায় কদমফুল। ভাবুকের মন আরও বেশি উদার ও প্রেম-ভালোবাসায় ভরে ওঠে। এ সময় প্রকৃতিতে ফুটে ওঠে হরেক রকমের ফুল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ কদম, কেয়া, শাপলা, পদ্ম, দোলনচাঁপা, ঘাসফুল, কুমড়া ফুল, ঝিঙেফুল, কচুফুল, কেশরদাম, পাতা শেওলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, হেলেঞ্চাফুল, অর্কিড, কলমি ফুল, ফণীমনসা, গোলপাতা ইত্যাদি ফুল প্রকৃতিকে আরও মোহিত করে তোলে। বর্ষাকালের ফলগুলোও পুষ্টিগুণে ও রসে ভরা থাকে। বর্ষাকালে পর্যটন স্থানগুলো আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। বর্ষাকে ভালোবাসার ঋতু বললেও অত্যুক্তি হবে না। বর্ষা ছাড়া প্রকৃতি যেন পূর্ণতা পায় না। বলা যায় বর্ষা, প্রকৃতি-পরিবেশ ও সৌন্দর্য একই সরলরেখায় বাধা। বর্ষার নাচন মানবমনে এক রহস্যময় আবেগ তৈরি করে। বর্ষায় চারপাশ ধুয়ে-মুছে ছাপ হয়ে যায়। প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় বর্ষা। মাঝে মাঝে আবার প্রকৃতি যেন তার ব্যাকরণ ভুলে যায়। গ্রীষ্মকালে খরার কবল থেকে বাঁচতে কোথাও বৃষ্টিবন্দনাও দেখা যায়।