কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু : আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়া ঠেকাতে পারলেও মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার আড়িয়ল বিলে অবৈধ হাউজিং কোম্পানির অপতৎপরতা ঠেকাতে পারছে না বিলবাসী। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে জমির মূল্য বেশ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলাধীন আড়িয়ল বিলের পূর্ব প্রান্তে গড়ে উঠেছে একাধিক হাউজিং কোম্পানি। আর এসব কোম্পানি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ঘেঁষে ও আড়িয়ল বিলের অভ্যন্তরীণ সড়কের পাশে সামান্য পরিমাণ কৃষিজমি ক্রয় করে এবং কৃষকের জমি ভাড়া নিয়ে গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে অভিনব কৌশল নিয়েছে। প্রতারণার কৌশল বাস্তবায়নে চোখ ধাঁধানো বিলবোর্ড বসিয়ে আকর্ষণীয় অফারের বিজ্ঞাপন দেওয়া দু’একটি ছাড়া বেশিরভাগ হাউজিং কোম্পানিগুলোর সরকারি কোন অনুমোদন নেই, এমনকি নেওয়া হয়নি পরিবেশ ছাড়পত্রও। আর এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত অবৈধ হাউজিং কোম্পানির কার্যক্রম নিয়ে সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির সভায় আলোচনা ও গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশনা পাওয়ার পর মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন এসব অবৈধ হাউজিং কোম্পানির তালিকা তৈরীর পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসন আড়িয়ল বিলের বিভিন্ন ইউনিয়নের তহসিলদারদের মাধ্যমে তালিকা তৈরী করতে মাঠে নেমেছে। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ঘেঁষে আড়িয়ল বিলের হাঁসাড়া, ষোলঘর ও কেয়টখালী মৌজায় গড়ে তোলা হয়েছে পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড, রয়েল প্রপারটিজ, ধরিত্রী, শান্তি নিবাস, দখিনাচল, মেরিন গ্রুপ, বাতায়ন ও বারিধারা হাউজিং কোম্পানি নামে পরিবেশের ছাড়পত্রহীন অবৈধ হাউজিং কোম্পানি। আর এসব অবৈধ হাউজিং কোম্পানির মধ্যে দু-একটি কোম্পানি আবাসনের নামে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই আড়িয়ল বিলের বিভিন্ন মৌজার কৃষিজমি ভরাট করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে উঠেছে। এছাড়া অপর হাউজিং কোম্পানিগুলো কৃষকের জমি ভাড়া নিয়ে চোখ ধাঁধানো বিলবোর্ড বসিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। অন্যদিকে এসব কোম্পানি প্রতারণার পাশাপাশি জমিতে বিলবোর্ড টানানো নিয়ে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছে।
শ্রীনগর পুলিশ জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের কেয়টখালী গ্রামে মৈত্রী গ্রুপ ও বারিধারা গ্রুপ এবং মৈত্রী গ্রুপ ও পুষ্পধারা নামের তিনটি হাউজিং কোম্পানি সাইনবোর্ড টানানো নিয়ে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ঘেঁষে আড়িয়ল বিলের কেয়টখালী মৌজায় “পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড” নামের একটি হাউজিং কোম্পানি প্রায় ৭৫ হাজার বর্গমিটার এক সময়ের উর্বর জমি দখল করেছে। কোম্পানিটি জলাভূমিতে ভূমি ভরাট কার্যক্রমের সুবিধার্থে একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের এক কর্মকর্তা জানান, “পদ্মা ইকো-সিটি” প্রকল্পের অধীনে পুষ্পধারা প্রপার্টিজ ৩০০ কাঠা জমিতে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, তারা জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি নিয়েই এসব কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ক্রয়কৃত জমি ভরাট করেই তারা প্লট তৈরী করে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করছেন।
অপরদিকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ঘেঁষে আড়িয়ল বিলের একই মৌজায় কৃষিজমিতে ‘বারিধারা হাউজিং প্রকল্প’ নামে একটি কোম্পানির অসংখ্য বিলবোর্ড স্থাপন করে রাখার দৃশ্য দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বারিধারা হাউজিং কোম্পানির পরিচালক মোঃ হুমায়ুন কবির বুলবুল বলেন, ষোলঘর ও কেয়টখালী মৌজায় তাদের ৩৫ একর পৈতৃক সম্পত্তির কিছু জমি ভাড়া নিয়ে মৈত্রী গ্রুপ নামের একটি কোম্পানি সাইনবোর্ড লাগিয়েছিল। পরবর্তীতে তারা তাদের পুরো সম্পত্তিতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দখলের চেষ্টা চালায়। তাই সেই সম্পত্তি রক্ষার জন্য বারিধারা হাউজিং কোম্পানি নাম দিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছি।
তিনি বলেন, জমিতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখলেও অনুমোদনের জন্য এখনও আবেদন করা হয়নি।
শ্রীনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ তাজুল ইসলাম জানান, তার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো হাউজিং কোম্পানিকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। তার ইউনিয়নের যেসব কৃষিজমিতে হাউজিং কোম্পানির বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে, তার সবই অবৈধ।
মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের এস এ শাখা সূত্রে জানা গেছে, শ্রীনগর উপজেলাধীন একাধিক হাউজিং কোম্পানি ‘দায় মুক্তি সনদ’ পেতে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করলেও একমাত্র কেয়টখালী মৌজায় পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড নামের একটি হাউজিং কোম্পানিকে সনদ দেওয়া যেতে পারে মর্মে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আর কোনো হাউজিং কোম্পানিকে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়নি। এছাড়া একাধিক কোম্পানি এখনও পর্যন্ত জেলা প্রশাসক বরাবর ‘দায় মুক্তি সনদ’ পেতে আবেদনই করেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আড়িয়ল বিলের হাঁসাড়া, ষোলঘর ও কেয়টখালী মৌজায় যেসব হাউজিং কোম্পানির বিলবোর্ড সাটানো হয়েছে, তা কৃষকের জমি ভাড়া নিয়ে স্থাপন করেছে।
কেয়টখালী গ্রামের কৃষক দীন ইসলাম জানান, বছরে ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় তার ৭০ শতাংশ জমিতে একটি হাউজিং কোম্পানি একাধিক বিলবোর্ড স্থাপন করেছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, বছর অনুযায়ী চুক্তি হিসেবে সাইনবোর্ড ভাড়া নিয়েও জমির মালিকদের ভাড়া দিচ্ছেন না একাধিক কোম্পানি।
স্থানীয় গ্রামবাসী ও ভুক্তভোগীরা জানান, এসব হাউজিং কোম্পানিগুলোর ৯৫ ভাগই অবৈধ। তারা কৃষকের জমি ভাড়া নিয়ে অভিনব কৌশলে গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে সক্রিয়। ইতিমধ্যে একাধিক গ্রাহক তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। আবার টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য বারবার ধর্না দিয়ে উল্টো হয়রানিরও শিকার হচ্ছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে জায়গা মূলত বার্ষিক ভিত্তিতে ভাড়া নেওয়া। বাঁশের খুঁটি, লোহার অ্যাঙ্গেল ও পাকা পিলারের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা এক একটি সাইনবোর্ড আধুনিক শহরের নামে প্রতারণার ফাঁদ।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিমধ্যে এসব অবৈধ ও ভুয়া হাউজিং কোম্পানির ফাঁদে পড়ে একাধিক গ্রাহক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এমনকি প্রতারণার শিকার হওয়া গ্রাহকরা তাদের টাকাও ফেরত না পেয়ে এখন সর্বস্ব হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বারবার ধর্না দিলেও টাকা ফেরত পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
প্রতারণার ফাঁদে পড়া বাগেরহাট জেলার হাফিজুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগী জানান, তিনি ও তার ছোট ভাই মাহফুজুর রহমান কয়েক বছর আগে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসেওয়ে ঘেঁষা একটি হাউজিং প্রকল্পে ৩ কাঠা করে মোট ৬ কাঠা জায়গা কিস্তিতে ক্রয় করতে চুক্তিবদ্ধ হন। প্রথম কিস্তিতে ২ লাখ টাকা দেওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, পদ্মা সিটি হাউজিং কোম্পানির ক্রয় করা কোন জায়গা নেই। স্থানীয় মানুষের জমি ভাড়া নিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে তারা প্রতারণা করছে। এরপর সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নিতে বহু চেষ্টা চালালেও এখনও পর্যন্ত টাকা ফেরত পাইনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের মতো এমন একাধিক গ্রাহক অবৈধ হাউজিং কোম্পানির ফাঁদে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
শ্রীনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় সূত্র জানায়, হাউজিং কোম্পানির বিষয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এসেছে। এরপরই বৈধ ও অবৈধভাবে হাউজিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নামের তালিকা তৈরী করতে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আড়িয়ল বিলে এ পর্যন্ত কোনো আবাসন প্রকল্পের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কোনো হাউজিং কোম্পানি পরিবেশ বিনষ্টে যুক্ত থাকলে খোঁজ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, আড়িয়ল বিলের কৃষিজমি ভরাট করে হাউজিং ব্যবসার বিষয়টি জানতে পেরেছি। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে উপজেলা প্রশাসনকে বৈধ ও অবৈধ হাউজিং কোম্পানির তালিকা তৈরী করে অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ঘিরে অবৈধ হাউজিং কোম্পানি জমি ভাড়া নিয়ে পেতেছে প্রতারণার ফাঁদ
আগের পোস্ট