নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট বাড়লেও কমছে শিক্ষার্থী। মূলত প্রতিষ্ঠান বাড়লেও সেগুলোয় শিক্ষক সংকট, উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশের অভাব এবং শিক্ষাজীবন শেষে চাকরিক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হারিয়ে ফেলছে। ফলে কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। দেশের সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোয় ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মোট ১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০টি আসন ছিল। তার বিপরীতে ৬৮ হাজার ৭৮২ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, যা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থাৎ ইনস্টিটিউটগুলোয় প্রায় ৬০ শতাংশ আসনই ওই শিক্ষা বছরে ফাঁকা ছিল। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এবং কারিগরি শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিগত ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে মোট ৮১ হাজার ৭৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ওই শিক্ষাবর্ষে ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ আসন ফাঁকা ছিল। তারপরের শিক্ষাবর্ষে ৭৭ হাজার ২৭২ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ৫৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ আসন ছিল শূন্য। তাছাড়া ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ছিল ৭৩ হাজার ২৭২ জন, ফাঁকা আসন ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ; ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয় ৭১ হাজার ৫৫৩ শিক্ষার্থী, আর ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ আসন ফাঁকা পড়ে ছিল।
সূত্র জানায়, কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হলেও তার বিপরীতে বিগত সময়ে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের যথাযথ সংযোগ স্থাপন করা হয়নি। তাছাড়া মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে ধরনের দক্ষ লোকবল প্রয়োজন তা নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং নতুন শিক্ষার্থীরাও ভর্তিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তবে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সংযোগ স্থাপন করা গেলে, বিশেষত আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়, তবে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে।
সূত্র আরো জানায়, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ কর্মজীবী, ৪ শতাংশ উদ্যোক্তা, ৩৮ শতাংশ বেকার ও ৪ শতাংশ কাজে আগ্রহী নয়। তবে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার বেশি। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৪৮ শতাংশ ডিপ্লোমাধারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ২৭২ ডিপ্লোমাধারীর ওপর ওই গবেষণা করা হয়। ওই প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী কর্মজীবীদের ৬৫ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ২৪ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে, ৬ শতাংশ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা এনজিওতে ও ৫ শতাংশ কাজ করছেন সরকারি প্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ওই ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের ৪৪ শতাংশের মাসিক আয় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যে এবং ৪৩ শতাংশের আয় ১০ হাজার টাকার কম। মাত্র ১৩ শতাংশের মাসিক আয় ১৫ হাজারের ওপর। তাছাড়া বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) জরিপের তথ্যানুযায়ী ডিপ্লোমা প্রকৌশলীর ডিগ্রি নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭১ শতাংশ ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে বেতন পাচ্ছে ।
এদিকে কারিগরি শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে, দক্ষ শিক্ষকের অভাব কারিগরি শিক্ষায় একটি বড় সংকট। শিক্ষক সংকটের কারণে বিগত কয়েক বছর প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরাও আশানুরূপ শিক্ষার পরিবেশ পায়নি। যে কারণে কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীও কমেছে। তবে এ সংকট দূর করতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বিগত কয়েক মাসে অনেক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে স্বতন্ত্র কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগের লক্ষ্যে টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনেকদিন ধরেই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। সম্প্রতি নতুন করে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা আরো বেশকিছু দাবি সামনে এনেছে। তার মধ্যে রয়েছে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ পদোন্নতি কোটা বাতিল, জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদোন্নতির রায় বাতিল, ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদবি পরিবর্তন, মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুত, ২০২১ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের নিয়োগ বাতিল এবং সেই বিতর্কিত নিয়োগবিধি অবিলম্বে সংশোধন করা।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন জানান, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা ভালো চাকরি পাচ্ছে না এটি সঠিক নয়। এখানে একটি বড় সমস্যা প্রচারণার অভাব এবং কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা। প্রচারণা বাড়ানোর জন্য এখন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তাছাড়া কিছু ভুঁইফোড় বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটও রয়েছে। দেখা যায় ওসব প্রতিষ্ঠানে সুযোগ-সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় না। বোর্ডের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধাহীন এসব ইনস্টিটিউটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।