* ভুল রিপোর্টে প্রায়ই হয়রানির শিকার হচ্ছে মানুষ
* কমিশনের লোভে প্রয়োজন ছাড়াই বিভিন্ন পরিক্ষা দিচ্ছে ডাক্তাররা
* হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যায় দালালরা
কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু : প্রতিদিন সকাল থেকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে প্রতিটি ডাক্তারের কক্ষ ও এর বাইরে অবস্থান করা একাধিক নারী-পুরুষের তৎপরতায় প্রথমে মনে হবে, তারা হাসপাতালের কর্মচারী বা কর্তব্যরত চিকিৎসকের আস্থাভাজন ব্যক্তি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব নারী-পুরুষ হাসপাতালের কর্মচারী নয়, তারা শহরের সুপার মার্কেট ও হাসপাতাল সড়কে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বেতনভুক্ত কর্মচারী। তাদের কাজই হলো, জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ফুসলিয়ে ও নানা প্রলোভনে ফেলে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে নেওয়া। তাই তারা দিন-রাত চষে বেড়ান মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ডাক্তারের চেম্বারসহ পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড এবং বহিরাঙ্গণে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে ও আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে ২৫ থেকে ৩০টি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এক শ্রেণির অর্থলোভী ডাক্তার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবসহ একাধিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। আর এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলো গড়ে উঠেছে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালকে ঘিরেই। জেনারেল হাসপাতালের শয্যা সঙ্কট ও চিকিৎসা সেবায় অব্যবস্থাপনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিয়োজিত দালাল চক্র নানা প্ররোচণায় রোগী ও তাদের স্বজনদের নিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি ক্লিনিকে ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। এছাড়া হাসপাতাল ও চেম্বার থেকেও কমিশনের লোভে চিকিৎসকরাও বিভিন্ন পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতে পাঠাচ্ছে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজি ল্যাবগুলোতে। তাই রোগীরা বাধ্য হয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে ছুটে যাচ্ছে। আর এ কাজে সহযোগিতায় রয়েছে নিয়োজিত দালাল চক্র।
অন্যদিকে হাসপাতালের কমিশন লোভী ডাক্তারের কাছে শরণাপন্ন হলেই রোগীর টাকা-পয়সা চুষে না নেওয়া পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি নেই। সাধারণ জ্বর বা পেট ব্যথা নিয়ে কোন রোগী হাজির হলেও কয়েক ধরনের পরিক্ষা-নিরিক্ষা দিয়ে দেয়। তাছাড়া হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স, সার্জারী এবং গাইনি ডাক্তাররাও রোগীদের প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে নানা অপারেশন ও সিজার করাচ্ছেন। ডাক্তাররা চিকিৎসায় কমিশন, পরিক্ষা-নিরিক্ষায় কমিশন, ঔষধে কমিশন ও অপারেশনের যাবতীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রয়েছে মোটা অঙ্কের কমিশন। তাই রোগীদের পাঠিয়ে দেয়া হয় ডাক্তারদের নির্ধারিত বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজিক্যাল সেন্টারগুলোতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ শহর ও আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক এন্ড প্যাথলজিক্যাল সেন্টারগুলোতে চলছে চিকিৎসার নামে কমিশন বাণিজ্যের ব্যবসা। জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার, নার্স ও দালালদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে জমজমাট হয়ে উঠেছে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক এন্ড প্যাথলজি ব্যবসা। সরকারি হাসপাতালে এবং ডাক্তারের চেম্বারে চিকিৎসা সেবা নিতে গেলে দূর-দূরান্ত থেকে আগত রোগীদের প্রয়োজন ছাড়াই রক্ত, প্রস্রাব পরিক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্সরেসহ বিভিন্ন পরিক্ষা-নিরিক্ষার ব্যবস্থাপত্র ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বলে দেওয়া হচ্ছে, কোন প্রতিষ্ঠানে এ পরিক্ষাগুলো করতে হবে। তাই রোগীরা ডাক্তারের নির্দেশিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে। আর এ সুযোগে ডায়াগনস্টিক এন্ড প্যাথলজিক্যাল সেন্টারগুলোর মালিকপক্ষ রোগীদের কাছ থেকে পরিক্ষা-নিরিক্ষার নামে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। আর সেই টাকার একটি অংশ কমিশন হিসেবে রাখা হচ্ছে যেসব ডাক্তার, নার্স ও দালালরা রোগী পাঠাচ্ছে, তাদের জন্য। ফলে সরকারি স্বাস্থ্য নীতির তোয়াক্কা না করে নানা অনিয়মের মধ্যে পরিচালিত বেসরকারি মালিকানাধীন এসব প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে পরিণত হয়েছে চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থলে। তাই এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক এন্ড প্যাথলজিক্যাল ব্যবসায় খোদ ডাক্তাররাও জড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শহরের মানিকপুরস্থ মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন সড়ক, আশপাশের এলাকা এবং সুপার মার্কেট এলাকায় একাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক এন্ড প্যাথলজিক্যাল সেন্টার গড়ে উঠেছে সরকারি হাসপাতালে আগত রোগীদের ঘিরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বপ্ননীড় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিয়োগকৃত দালাল তিনজন, নিউ স্কয়ারের তিনজন, বেস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দুইজন, প্রাইম ক্লিনিকের দুইজন, ফেমাস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দুইজন এবং ডক্টরস ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চারজন, নিউ মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তিনজন বেতনভুক্ত দালাল হিসেবে নিয়মিত জেনারেল হাসপাতালে বিচরণ করছে। এসব ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছাড়াও আরও একাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বেতনভুক্ত দালাল হাসপাতালে বিচরণ করছে। এসব দালালরা জেলার দূর-দূরান্ত থেকে আগত রোগীদের নিজ নিজ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের পল্লী চিকিৎসক ও ফার্মেসী ব্যবসায়ী পর্যন্ত। কমিশন বাণিজ্যে গ্রামাঞ্চলেও এসব প্রতিষ্ঠানের দালাল রয়েছে।
জানা গেছে, বেতনভুক্ত দালাল ছাড়াও কমিশন বাণিজ্যের লোভে হাসপাতালের কতিপয় নার্স, ওয়ার্ডবয়, কর্মচারীরাও বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগী পাঠানোর কাজে যুক্ত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাঃ মঞ্জুরুল আলম জানান, এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য হাসপাতালের অভ্যন্তরে ও বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এর আগে কয়েক দফা এসব দালালদের আটকের পর পুলিশে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পুরোপুরি দালালমুক্ত করা যায়নি। একেবারে নির্মূল করার চেষ্টা চলমান রয়েছে।