কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু : ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ডিজাইনের আদলে মুন্সীগঞ্জে টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরী হচ্ছে ঘর। আর টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত নান্দনিক ঘরে স্থাপন করা হচ্ছে এসি। মূলত কাঠ ও টিনের তৈরী ঘরের দরজা জানালায় থাই গ্লাস ব্যবহার করায় পাকা ভবনের মতো কাঠ ও টিনের তৈরি ঘরেও ব্যবহার করা যাচ্ছে এসি।
জেলার লৌহজং উপজেলার এমন বাহারি ঘর ও কটেজের দৃশ্য ইউটিউব ও ফেসবুক লাইভের বদৌলতে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে এই বাহারি নান্দনিক ঘরের খবর। যা দেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে আসছে ঘর ক্রয়ের জন্য। সব ধরনের নান্দনিক ঘর মিলছে এ এলাকায়। ঘরের সাথে মিলছে ঘরে বসানো এসিও। তাই কটেজ টাইপের ঘর কিনতে সিলেট, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, টেকনাফ থেকে বিভিন্ন রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা ছুটে আসছেন ঘর নিতে। এছাড়া কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরী ঘর মুন্সীগঞ্জের লোকজনের পাশাপাশি ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চাঁদপুর, গাজীপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা এসব ঘর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বড় নওপাড়া ও কলাবাগান এলাকায় প্রায় বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক টিন ও কাঠ দিয়ে ঘর। এক সময় এখানে এক থেকে তিন তলা পর্যন্ত কাঠ ও টিন দিয়ে ঘর তৈরি হতো। আগে এসব ঘরের চালে ব্যবহার করা হতো সাদা টিন। আর এখন সাদা টিনের পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন রঙিন টিন পাশাপাশি টালী টিন যা ঘরের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। তবে বর্তমানে সবচেয়ে আকর্ষণে পরিণত হয়েছে বিদেশি বাড়ির ক্যাটালগ দেখে তৈরি কাঠ ও টিনের ঘর। এসব ঘরের বৈশিষ্ট্য হলো অন্যান্য কাঠের টিনের তৈরি ঘরের বেড়ায় টিন ব্যবহার করা হলেও এসব ঘরের বেড়ায় এবং চালের নিচেও টিনের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় শুধু কাঠ। তাছাড়া ঘরের চালে দামি টালী রঙিন টিনের ব্যবহারের পরে টিনের নিচে কাঠ দিয়ে দেওয়া হয় আলদা প্রলেপ। মূলত এসব পুরো ঘর কাঠ দিয়ে মুড়ানো থাকায় এবং কাঠের জোড়ার মধ্যের স্থানগুলো পুটিন দিয়ে ঢেকে তাতে বাহারী রং এবং দরজা-জানালায় থাই গ্লাস ব্যবহার করায় অনায়াসে এসব ঘরে এসি ব্যবহার করা যায়। এসির বাতাস ঘরের বাইরে যেতে পারে না।
বড় নওপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একাধিক কটেজ টাইপের ঘরের সাথে এসিও বসানো রয়েছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, টঙ্গীবাড়ী, সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ঘর তৈরীর কারখানা। এসব স্থানে আগে থেকেই টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরী করে রাখা হয় ঘর। এক থেকে তিন তলা পর্যন্ত ঘর। বর্তমানে এসব ঘরের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে কটেজ ঘর। যেসব ঘর দূর-দূরান্ত থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এসে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে ঘর তৈরীতে ভিন্নতা নিয়ে এসেছে টালী টিন। বিশেষ ধরনের রঙিন টিনের কারণে ঘরের নান্দনিক সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এসব ঘরের দিকে ঝুঁকছে ক্রেতারা।
জানা গেছে, কটেজ টাইপের ঘরগুলোতে এসি বসিয়ে পাকা ভবনের মতোই ঠান্ডা করা যাচ্ছে। অন্যদিকে কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি অন্যান্য ঘরগুলোতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস অনায়াসে প্রবেশ করেতে পারছে। আবহাওয়ার সঙ্গে ঘর দ্রুত ঠান্ডা ও গরম হয়। একটি পুরো ঘর অনায়াসে ভেঙ্গে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়। টাকার প্রয়োজনে বিক্রিও করেও দেওয়া যায়। ফলে এসব ঘরের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশের প্রায় সব স্থান হতে ক্রেতারা এসব ঘর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আগে এসব ঘর তৈরীতে বার্মার লোহা কাঠ, শাল কাঠ ও টিনের ব্যবহার ছিল বেশি। কিন্তু বার্মার লোহা কাঠের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া। তাছাড়া ওই কাঠ এখন আর এদেশে তেমন পাওয়া যায় না। বৃদ্ধি পেয়েছে শাল কাঠের দামও। তাই বিকল্প হিসেবে নাইজেরিয়ান লোহা কাঠ, সেগুন কাঠ ও টিন দিয়ে অধিকাংশ ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। কটেজ টাইপের ঘরগুলোর বেড়ায় টিনের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে মেহগনি ও কেরাসিন কাঠ। এ কাঠগুলো সাধারণত নরম ও স্থায়ী হওয়ায় এ কাঠগুলো কটেজ ঘরের বেড়া ও চালের নিচে ব্যবহার করা হয়। এ ঘরের খাম, রোয়া, আড়ায় ব্যবহার করা হয় অন্যান্য ঘরের মতোই নাইজেরিয়ান লোহা কাঠ। যা অনেক শক্ত ও মজবুত। স্থায়িত্ব ১০০ বছর। এছাড়া দেশী কিছু কাঠ ব্যবহার হয়ে থাকে এসব ঘর তৈরিতে। তবে লৌহজংয়ের ঘৌড়দোর এলাকায় দেশীয় কাঠ দিয়ে তৈরী ঘরের কারখানাও রয়েছে। তবে দেশীয় কাঠ দিয়ে তৈরী ঘরের মূল্য বিদেশে কাঠ দিয়ে তৈরী ঘরের মূল্যের অর্ধেক। লোহা কাঠ দিয়ে নির্মিত ঘরগুলো সাধারণত ৬০ বছর থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। একেকটি টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত ঘর ১ থেকে ৩ তলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। হাটে ২-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের ঘর বিক্রি হয়। তবে অনেকেই বাড়িতে কাঠমিস্ত্রি এনে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়েও ২-৩ তলা প্রাসাদের মতো টিন ও কাঠ দিয়ে ঘর নির্মাণ করেন। নান্দনিক ডিজাইনের কারণে মুন্সীগঞ্জের সবকয়টি উপজেলায় এ ধরনের ঘরের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তাই এসব ঘর তৈরীর প্রধান উপকরণ কাঠ বিক্রির বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কাঠের ব্যবসা। বিশেষ করে টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বালিগাঁও বাজার, দিঘীরপাড় বাজার, মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মুন্সীরহাট, কাটাখালী, মীরকাদিম বাজার, লৌহজং উপজেলার ঘোড়দৌর এলাকায় রয়েছে বড় বড় কাঠের দোকান। এসব দোকানে পাওয়া যায় সব ধরনের কাঠ।
জানা গেছে, স্থানীয় ঘর ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গাছ কিনে নিয়ে আসেন। এরপর গাছগুলোকে ‘স’ মিলে কেটে সাইজ করেন। সেগুলোতে নকশা করেন নকশা মিস্ত্রিরা। টিনগুলো বিভিন্ন স্থান থেকে কিনে আনেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ডিজাইন করা টিন কিনতে পাওয়া যায়।
ঘরগুলো জমির ওপর দাঁড় করাতে ব্যবহার করা হয় কাঠ, সিমেন্ট ও লোহার খুঁটি। একটি পূর্ণাঙ্গ ঘর প্রস্তুত করতে কয়েক দফা কাজ করেন শ্রমিকরা। মুন্সীগঞ্জের এসব কারখানায় তৈরি ঘরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাঠের উপরে নান্দনিক ডিজাইন। এসব ঘর নির্মাণে গোপালগঞ্জের শ্রমিকদের আলাদা চাহিদা রয়েছে মুন্সীগঞ্জে। এ জেলায় গোপালগঞ্জ জেলার এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক ঘর নির্মাণ কাজে জড়িত বলে জানা গেছে।
কাঠমিস্ত্রি বিজয় দাস বলেন, আমি ৫ বছর ধরে এ কাজ শিখছি। আমরা মূলত কন্ট্রাকটারের কাজ করি। কন্ট্রাকটার আমাকে প্রতিদিন ৫৫০ টাকা দেয়। অভিজ্ঞ মিস্ত্রিদের দেওয়া হয় ৭০০-৮০০ টাকাও।
লৌহজং কলাবাগান এলাকার ঘর তৈরির কারিগর কামরুল ইসলাম বলেন, এ ঘরগুলো তৈরির জন্য কন্ট্রাকটর চুক্তি নেয়। একদিন কাজ করলে আমাকে ৭০০ টাকা দেওয়া হয়। আমি দুই বছর ধরে ঘরের কাজ করছি। তবে সিনিয়র মিস্ত্রিরা প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পায়।
ঘর তৈরির মহাজন মালেক সরদার বলেন, কটেজ ঘরগুলো মূলত ইউরোপের তৈরি বিভিন্ন ঘরের ক্যাটালগ দেখে তৈরি করি। এই ঘরগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলোতে থাই গ্লাস ব্যবহার করা হয়, যার কারণে বাইরের পানি ঘরে ঢোকার কোন সম্ভাবনা থাকে না। এগুলোর দরজা-জানালা আটকিয়ে দিলে বাতাস বাইরে যেতে পারে না। তাই সহজেই এসি ব্যবহার করা যায়।
কাঠমিস্ত্রি রাজু হোসাইন বলেন, কটেজ ঘরের বেড়ায় মেহগনি ও কেরাসিন কাঠ ব্যবহার করা হয়। মেহগনি ও কেরাসিন কাঠ একটু নরম হওয়ায় এ কাঠ দিয়ে সহজেই ডিজাইন করা যায়। তিনি বলেন, কটেজ টাইপের একটি ঘর তৈরি করতে আমাদের পাঁচ থেকে সাতজন মিস্ত্রির এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। এই ঘরগুলো তৈরি করতে সাত থেকে আট লাখ টাকা খরচ হয়।
ঘর ব্যবসায়ী জসিম বেপারী বলেন, এই ঘরগুলো মূলত ইউরোপীয় বাড়ির ক্যাটালগের আদলে তৈরি করা হয়। তাই এর চাহিদা বেশি। রিসোর্ট মালিকরা বিশেষ করে সিলেট, টেকনাফ, কক্সবাজার হতে লোকজন আমাদের এখানে ঘর নিতে আসে। আমার এখান হতে কেনার পরে আমি এর আগে মিস্ত্রি দিয়ে অনেক জায়গায় এই ঘরগুলো তুলে দিয়ে এসেছি।
তিনি আরো বলেন, এই ঘরের নির্মাণের খাম, আড়াসহ অন্যান্য কাঠগুলো নাইজেরিয়ান লোহা কাঠ ব্যবহার করা হয়। এই নাইজেরিয়ান লোহা কাঠের দাম অনেক বেশি। এক কিবি তিন হাজার টাকা। কাঠগুলো খুব শক্ত হওয়ায় এগুলো ১০০ বছরে স্থায়িত্ব হয়। আর মেহগনি কাঠের তৈরী ঘর ৪০ থেকে ৫০ বছর স্থায়ী হয়। তাছাড়া এই ঘরের দরজাগুলোতে থাই ব্যবহার করায় সহজে এগুলোতে এসি ব্যবহার করা যায়।
তিনি আরো বলেন, শুধু লৌহজং কাঠপট্টি এলাকায় রয়েছেন ৩০ জন ঘর ব্যবসায়ী। বিভিন্ন ইউটিউব এবং মিডিয়ায় প্রচারের কারণে দিন দিন আমাদের ঘর বিক্রি বাড়ছে। বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসে ঘর কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
মেসার্স আবিদ তিনবার ট্রেডার্স এর স্বত্তাধিকারী বড় নওপাড়া এলাকার ঘর ব্যবসায়ী ইমরান হোসেন বলেন, আমি বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে এ ব্যবসা করি। গত কয়েক বছর যাবৎ যেভাবে গরমের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে তাই কিভাবে টিনের ঘরেও এসি লাগানো যায়, সেই ভাবনা থেকেই কটেজ ঘর তৈরি করছি। যা পুরোটাই চাল ছাড়া, মূলত কাঠ ব্যবহার করা হয়। চালের নিচেও কাঠ দেওয়া হয়। অন্যান্য কাঠের ঘরের যেমন টিনের বেড়া হয় এগুলোর বেড়া কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা হয়। তারপরে বাহারি রং করা হয়। ফলে এসি লাগানোর পরেও ভিতর থেকে হাওয়া বের হতে পারে না।