কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু : অপরিকল্পিত বাজার ব্যবস্থাপনায় বরাবরই ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষক। গত বছর আলুতে ভালো দাম পাওয়ায় এবার আবাদ বাড়িয়েছিল কৃষককূল। কিন্তু আলু তোলার পর সিন্ডিকেটের কারসাজিতে মূল্য কমে যাওয়ায় এবার লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচই উঠছে না কৃষকের। ফলে লাখ লাখ টাকা লোকসানের আশঙ্কায় মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ নিয়ে দিনাযাপন করছে কৃষকেরা।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ন্যায্য দাম না পেলে আলু আবাদে নিরুৎসাহিত হবে কৃষক। আর দেশ পড়বে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে। তবে আগামী দিনগুলোতে আলুর দাম বাড়বে বলে আশাবাদ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে আলুর চাহিদার একটি বড় অংশের জোগান দেয় মুন্সীগঞ্জ। এই জেলার আলু মৌসুমের শেষদিকে বাজারে ওঠে। গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবার দুই একর বেশি জমিতে আলুর আবাদ করেন সিরাজদিখান উপজেলার কৃষক মোজাম্মেল ব্যাপারী। তবে বাজারে আলুর মূল্য কমে যাওয়ায় এবং কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া দ্বিগুণ হওয়ার খরচের চাপে লোকসানের শঙ্কায় ভুগছে কৃষক।
কৃষক মোজাম্মেল ব্যাপারী বলেন, হিমাগারের ভাড়া এবার বেড়েছে। আর উৎপাদনে যে খরচ হয়েছে এবং বর্তমানে বাজারমূল্য যেভাবে কমেছে তাতে কৃষক লোকসানের কবলে পড়ছেন, তা বাজারমূল্য দেখে বুঝতে পেরেছেন আগেই।
একই কথা বলেছেন টঙ্গীবাড়ী উপজেলার ধামারণ গ্রামের কৃষক শাহাবুদ্দিন হালদার, আলম শেখসহ একাধিক কৃষক। তারা বলেছেন, প্রতি কেজি আলু উৎপাদন খরচ পড়েছে কেজিতে ১৮ টাকা পর্যন্ত। তাই মৌসুমের শুরুতেই লোকসানের মুখে তারা। এই লোকসান থেকে বাঁচতে আলু সাধারণত হিমাগারে রাখেন। কিন্তু এবার হিমাগার ভাড়া কেজিতে ১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা নির্ধারণ করেছে হিমাগার সমিতি। গত বছরও ৫০ কেজির প্রতি বস্তার ভাড়া ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এবার তা ৪০০ টাকা। বাড়তি ভাড়া এখন মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ক্ষুদ্ধ কৃষক।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলু উৎপাদনের শীর্ষ জেলা মুন্সীগঞ্জে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে প্রখর রৌদ্রের তাপে ঘাম ঝড়িয়ে রোপণ করা আলুর বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। এ বছর জেলার ৩৪ হাজার ৭৫৮ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আর আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে জেলার সচল থাকা ৫৮টি হিমাগারে ধারন ক্ষমতা অনুযায়ী ৪ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। বর্তমানে হিমাগারগুলোতে তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই। ফলে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় উৎপাদিত বিপুল পরিমাণের আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করতে পারেনি। বিকল্প ব্যবস্থায় বাঁশের মাচায় সংরক্ষণ করলেও প্রায়ই পচন ধরে যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে আলু পানির দামে বাজারে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে।
অন্যদিকে সরকারি হিসেবে এবার কেজি প্রতি আলুর উৎপাদন খরচ ১৫ টাকা। গত বছর ছিল ১৩ টাকা। তবে, উত্তরবঙ্গের কৃষকরা জানিয়েছে, এবার তাদের খরচ পড়েছে প্রায় ২০ টাকা। অথচ দাম মিলছে ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে। আর এই আলু ঢাকায় পাইকারিতে ১৫-১৭ টাকা ও খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকা।
কৃষকের অভিযোগ, হিমাগারভিত্তিক মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে সস্তায় আলু কিনতে পারে, সেই লক্ষ্য নিয়েই হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণ করা বন্ধ ঘোষণা করে। ফলে অনেক কৃষক জমিতে বা নিজ বাড়ির আঙিনায় বিকল্প পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণের আলু সংরক্ষণ করেছে। তবে প্রচন্ড গরমে পচনের শঙ্কায় সেই আলু কৃষককে কম মূল্যে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে।
কয়েকজন আলু চাষি বলেন, এ বছর এতো লোকসান হবে তা ছিল কল্পনার বাইরে। লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচের বিঘা প্রতি ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকের।
আলু চাষিরা অভিযোগে জানিয়েছে, এবার হিমাগারকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের কারণে কয়েকগুণ বেশি দামে আলুবীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ কিনতে হয়েছে তাদের। ফলে প্রতি কানি (১৪০ শতাংশ) জমিতে আলু চাষে ব্যয় হয়েছে পৌনে ৪ লাখ টাকা। যদিও এলাকাভিত্তিক এই খরচ কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। সেই হিসেবে এই অঞ্চলে প্রতি মণ আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।
কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, হিমাগারকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের লোকজন অন্য জেলা থেকে আলু এনে মুন্সীগঞ্জের হিমাগারে সংরক্ষণ করেছে। তাই হিমাগারে আলু রাখতে পারেনি জেলার অধিকাংশ কৃষক। ৫৮টি সচল থাকলেও হিমাগারে আলু রাখতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, একসঙ্গে অনেক কৃষক আলু বিক্রি করায় এবং বাজারে সহজলভ্যতার কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা সম্পন্ন। এখন কিছুটা হলেও আলুর দাম বৃদ্ধি পাবে।
মুন্সীগঞ্জে লোকসানের কবলে কৃষক ; লাভ তো দূরের কথা আলুর উৎপাদন খরচই উঠছে না
আগের পোস্ট