নিজস্ব প্রতিবেদক
বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে সারা দেশ থেকে পণ্য ঢাকায় ঢুকতে ভাড়া বেড়েছে। এতে পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়ে গেছে। বেড়েছে দামও। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে ভোক্তাদের ওপরে। অবরোধের আগে এক ট্রাক সবজি বা অন্য খাদ্য পণ্য বাইরে থেকে ঢাকায় আনতে যেখানে খরচ হতো দূরত্ব ভেদে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। এখন একই পণ্য একই স্থান থেকে ঢাকায় পরিবহনে খরচ গুনতে হচ্ছে ১৯ থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত। তারপরও সব ট্রাক ঢাকায় আসতে চায় না; অবরোধকারীদের অগ্নিসংযোগের আতঙ্কে থাকেন। যারা আসছেন তাদের বাড়তি টাকা দেওয়া লাগছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। অবরোধের জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি কয়েক হাজার ট্রাক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্যবোঝেই করে রাজধানীতে প্রবেশ করছে।
এ বিষয়ে কাওরানবাজারে কথা হয় ট্রাক ড্রাইভার গিয়াস উদ্দিনের (২৮) সঙ্গে। তিনি যশোরের গদখালি থেকে মিষ্টিকুমড়া নিয়ে এসেছেন। গিয়াস জানান, অবরোধের সময় তিনি ট্রাক ভাড়া পাবেন ১৯ হাজার টাকা। অবরোধের আগে একই ওজনের একই পণ্য এনেছিলেন ১৬ হাজার টাকা ভাড়ায়। তিনি বলেন, অবরোধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক চালাতে হয়। সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয়, কখন কোন দিকে থেকে অবরোধকারীরা ট্রাকে হামলা করে। গ্লাসে একটি ঢিল মারলে যে ক্ষতি হবে তা এক মাসের ভাড়া দিয়েও উঠবে না। আর আগুন দিলে পুরো ট্রাক শেষ, এমনকি জীবনও যেতে পারে। এই ঝুঁকি নিয়েই আসছি, ভাড়া তো একটু বেশি নেবই।
এমন অভিযোগ সুজন মাদবরের। তিনি ফুলকপি নিয়ে এসেছেন চুয়াডাঙ্গা থেকে। সুজন বলেন, তারা আমিরুল ইসলাম নামে এক মহাজনের পুরোনো ট্রাকচালক। অনেকদিন থেকেই আমিরুলের পণ্য ঢাকায় নিয়ে আসেন। তিনিও বেশি ভাড়া পাচ্ছেন। অন্য সময়ের থেকে তিন থেকে চার হাজার টাকা বেশি ভাড়া পাচ্ছেন হরতাল-অবরোধের সময়। তিনি বলেন, অবরোধে ছেলেমেয়েরা ট্রাক চালাতে নিষেধ করে, কিন্তু সংসার তো আছে। আতঙ্ক নিয়ে ট্রাক চালাই, কখন কি হয়। কিছু হলে কেউ না দেখলেও পরিবার-পরিজনের কথা চিন্তা করে ট্রাক নিয়ে বের হই।
একই আশঙ্কার কথা জানালেন কুষ্টিয়া থেকে চাল নিয়ে আসা ড্রাইভার আনছার আলী। তিনি মোহাম্মদপুর বাজারে আড়তে চাল নামিয়েছেন। তিনি বলেন, সপ্তাহের শুক্র, শনি ও মঙ্গলবার অবরোধ দিচ্ছে না। এই কয়দিনই ট্রাক চালাই। অবরোধে বসে থাকি। এরপরও ভয় পিছু ছাড়ছে না।
অবরোধের কারণে ঢাকার বাইরে থেকে আসা পণ্যের খরচ বেড়ে গেছে। এর ফলে শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবজির দাম কমার কথা ছিল, কমছেও। কিন্তু যে হারে কমার কথা ছিল সে হারে কমছে না। বাড়তি পরিবহন ভাড়ার কারণে পণ্যের দামও বাড়ছে।
কারওয়ান বাজারে মূলা নিয়ে আসা হাফিজুর রহমান জানান, তিনি সংবাদপত্রের ফিরতি গাড়িতে করে মূলা নিয়ে এসেছেন। হাফিজুর বলেন, অবরোধের আগে যে বস্তা ৯০ টাকা ভাড়া দিয়ে এনেছিলাম, অবরোধের সময় একই বস্তার ভাড়া গুনতে হয়েছে ১৩০ টাকা। এর ফলে প্রতি কেজি মূলাতে খরচ বেড়েছে এক থেকে এক টাকা ৫০ পয়সা। তারপরও আগের মতো ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যের চেয়ে বেশি ভাড়া দিলেই কেবল ট্রাক ঢাকায় আসে বলে জানান তিনি। অন্য সবজি, ফল বা পণ্যেও এভাবে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।
অবরোধের কারণে ব্যবসায়ীদের যাতায়াত কমে গেছে। আগে ঢাকা থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে সবজি ঢাকার আনার জন্য ব্যবসায়ীরা মোবাইলফোনে যোগাযোগ করার পাশাপাশি সশরীরে এসব পণ্যের উৎপাদন স্থলে যেতেন। এখন অনেকেই আর এলাকায় যাচ্ছেন না। প্রয়োজনে ফোনে ফোনে কথা বলে পণ্য আনছেন। খুব প্রয়োজনে দুয়েকজন যাচ্ছেন বা কর্মচারী পাঠাচ্ছেন। এতে পণ্যটি ঢাকায় এলেও দাম বা মানের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে। কোনো কোনো সময় প্রত্যাশার মতো কাজটি হচ্ছে না।
যাত্রাবাড়ী, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর মার্কেটে খোঁজ নিয়ে একই খবর পাওয়া যায়। অবরোধ-হরতালের প্রভাবের দেখা মিলেছে বাজারে। শীতকালীন শাকসবজির দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি। মাছের বাজারও চড়া। বিক্রেতারা বলছেন, হরতাল-অবরোধে সরবরাহ কম, তাই দাম বেশি।
মাছের বাড়তি দামের বিষয়ে মাছ বিক্রেতা সুজন মিয়া বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকার বাজারগুলোতে মাছ কম আসছে। পরিবহন সংকটে গাড়ি ভাড়াও বেশি দিতে হচ্ছে। এ কারণে মাছের বাজার বাড়তি যাচ্ছে।
অবরোধ চললে ঢাকার বাইরে থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের গাড়ি পাহারা দিয়ে নিজ নিজ এলাকা পার করে দিচ্ছে বলে জানালেন যশোরের গদখালি থেকে আসা গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, মাঠ বা ছোট বাজার থেকে ট্রাকবোঝাই করে সড়কে উঠলেই দাঁড় করিয়ে পুলিশ অনেকগুলো ট্রাক এক সঙ্গে করে নিজ জেলা পার করে দিচ্ছে। পরের জেলায় ওই জেলার পুলিশ পাহারা দিয়ে পার করে দিচ্ছে। রাজশাহী থেকে আসা ব্যবসায়ীও এমন কথা জানালেন।
প্রসঙ্গত, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ও তফসিল প্রত্যাখ্যান করে দেশজুড়ে টানা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি, জামায়াত, গণঅধিকার পরিষদ, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি দল। আগামীকাল রোববার থেকে এ হরতাল পালন হবে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে হামলা ও সংঘর্ষের পরদিন দলটি সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে টানা তিনদিন অবরোধ কর্মসূচি দেয় তারা। এরপর শুক্র ও শনিবার বিরতি দিয়ে ৫ ও ৬ নভেম্বর অবরোধ পালন করে বিএনপি। তারপর ৭ নভেম্বর একদিনের বিরতি দিয়ে ৮ ও ৯ নভেম্বর অবরোধ দেওয়া হয়। পরে শুক্র ও শনিবার বিরতি দিয়ে আবার চতুর্থ দফায় অবরোধের ডাক দেয় বিএনপি। এরপর ১৫ ও ১৬ নভেম্বর পঞ্চম দফায় অবরোধ পালন করে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল।