নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রমত্তা পদ্মা, মেঘনা, গোমতি, ধলেশ্বরী ও ইছামতি বিধৌত বিস্তীর্ণ শস্য-শ্যামল অপরূপা এক প্রাচীন জনপদ মুন্সীগঞ্জ। ইতিহাসে এই অঞ্চল বিক্রমপুর হিসেবে সমাধিক পরিচিত। মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের রয়েছে হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক প্রাচুর্যতা। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাস নির্ভর এই জনপদে জগৎখ্যাত বহু মনীষী জন্মলাভ করেছেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, শিক্ষা, ক্রীড়া, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দেদীপ্যমান শিখা শুধু এই ভূ-খন্ডকেই নয়; বিশ্ব পরিমন্ডলকেও করেছে আলোকিত। বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ধর্ম সমন্বয় ও সংশ্লেষণের ধারায় সমৃদ্ধ বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের ইতিহাস। বিক্রমপুর অঞ্চলে সকল ধর্মের মনীষীদের কর্ম-সাধনা এবং উচ্চকিত জীবন ও সমুজ্জ্বল দর্শন অনাদিকাল থেকে আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং শিল্পায়নেও এই জেলার মানুষের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। আলাদা জেলা হলেও এলাকাটি রাজধানী ঢাকার খুব নিকটবর্তী হওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা সবকিছুই রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। মুন্সীগঞ্জের মানুষ একদিকে যেমন ঢাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা, ঠিক তেমনি ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটের দোকান ব্যবসায়ীদের সিংহভাগ লোকই মুন্সীগঞ্জের। অন্যদিকে এদেশের বৃহত্তম শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে মুন্সীগঞ্জবাসীর অংশগ্রহণ তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া মুন্সীগঞ্জ এলাকাটি দেশের বৃহত্তম আলু উৎপাদন অঞ্চল এবং রাজধানী ঢাকার ইলিশসহ অন্যান্য মাছের চাহিদার বিরাট একটি অংশ উৎপাদিত হয় মুন্সীগঞ্জে। একইসাথে মুন্সীগঞ্জের প্রবাসী আয় দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেকটাই বেশি। কাজেই জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই এলাকার মানুষের অবদান অনেক। বর্তমান সরকারের সময়কালে এ এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়ন হয়েছেÑ গড়ে উঠছে নতুন নতুন কল-কারখানা।
ইতিহাস প্রসিদ্ধ জনপদ মুন্সীগঞ্জ দেশের আর্থ-সামাজিক শিল্প-সাহিত্য, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল এলাকাটি ছিল সুবিধাবঞ্চিত। বিশেষত যোগাযোগ, শিক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিক থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মুন্সীগঞ্জ ছিল অনেকটাই পশ্চাৎপদ। অথচ মুন্সীগঞ্জ জেলার অগণিত মানুষকে প্রতিনিয়ত ঢাকায় যাতায়াত করতে হয়। ১৯৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মুন্সীগঞ্জ জেলা থেকে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং অসংখ্য প্রতাপশালী মন্ত্রী ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের উত্থান ঘটেছে। কিন্তু সেভাবে মুন্সীগঞ্জ জেলার উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়নি। মুন্সীগঞ্জবাসী দীর্ঘকাল থেকেছে উন্নয়ন সুবিধাবঞ্চিত। অসংখ্য নদ-নদী-খাল পরিবেষ্টিত এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মুন্সীগঞ্জের অভাবনীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ এবং ২০০৮ সাল থেকে আজ অবধি অসংখ্য উন্নয়ন কর্মসূচি এই জেলায় বাস্তবায়িত হয়েছে। বিশেষত, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আমি মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এই এলাকায় যে পরিমাণ উন্নয়ন কর্মসূচি গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে অন্য কোন সময়ে এতো কাজ হয়নি। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত ও প্রমাণিত। গত কয়েক বছরে এ এলাকায় অসংখ্য স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা-মন্দির, কবরস্থান-শ্মশান, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট স্থাপিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত চরাঞ্চলেও শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ কলেজ, গার্মেন্টস পল্লী, ঔষধ পল্লীসহ একাধিক ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। গজারিয়া উপজেলাটিতে দেশের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ বিনিয়োগ করছে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মুন্সীগঞ্জের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বের ফসল পদ্মাসেতু। মুন্সীগঞ্জ জেলায় একদিকে দেশবাসীর আত্মমর্যাদার স্মারক স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে এবং পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের প্রথম এক্সপ্রেস-ওয়ে ‘ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেস-ওয়ে’ নির্মিত হচ্ছে। অন্যপ্রান্তে মুন্সীগঞ্জের ‘মুক্তারপুর ব্রীজ থেকে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ’ কর্মসূচি গতকাল ৮ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়েছে।
আমি বেশ কয়েকদিন ধরে কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী। আজ আমার স্বপ্নের প্রকল্প ‘মুক্তারপুর থেকে পঞ্চবটি সড়ক প্রশস্তকরণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ’ কর্মসূচি একনেক সভায় অনুমোদিত হওয়ায় আমি আবেগাপ্লুত। প্রকল্পটি গ্রহণ করায় আমার অভিভাবক ও মাতৃতুল্য নেত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মাননীয় সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। আজ এই পরম আনন্দক্ষণে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দু’ফোটা অশ্রুর অঞ্জলি এবং দোয়া, আর্শীবাদ ও শুভ কামনা ছাড়া অভিব্যক্তি প্রকাশের আর কোনো সুযোগ নেই। অসুস্থ শরীরেও আজ মনটা অনেক উৎফুল্ল। আমার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা, স্বপ্ন এবং প্রত্যাশার সফল বাস্তবায়নের রূপরেখা দেখতে পারছি। মুন্সীগঞ্জ-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর একাধিকবার জাতীয় সংসদে মুক্তারপুর থেকে পঞ্চবটি সড়ক প্রশস্তকরণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ কর্মসূচির দাবী জানিয়েছি। মহান জাতীয় সংসদে এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছি। এর বাইরেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে এই প্রকল্প গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপির সাথে লেগে থেকেছি।
মুন্সীগঞ্জের অভ্যন্তরীণ এবং মুন্সীগঞ্জের সাথে রাজধানীসহ অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা একসময় অত্যন্ত নাজুক ছিল। গত কয়েক বছরে আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। কিন্তু মুন্সীগঞ্জ জেলা সদর থেকে ঢাকার সাথে যোগাযোগের একমাত্র সংযোগ সড়ক মুক্তারপুর থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত রাস্তাটি অত্যন্ত সংকীর্ণ হওয়ায় এই সড়কে যাতায়াত ছিল খুবই কষ্টদায়ক। এ সড়কটি খুবই সংকীর্ণ এবং আঁকাবাঁকা। অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে ৫টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও আলু সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোরেজ থাকায় প্রচুর ভারি যানবাহন চলচল করে। ফলে প্রায়শই এই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে এবং দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়কের প্রশস্ততা গড়ে মাত্র ছয় মিটার! কিন্তু সড়কটিতে বিদ্যমান অ্যানুয়েল এভারেজ ডেইলি ট্রাফিক (এএডিট) তথা প্রতিনিয়ত যান চলাচলের পরিমাণ ১৭ হাজার ৯১০টি। যে কারণে আমি এই সড়কে যাতায়াতের সময় এলাকার মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে প্রতিনিয়ত বিচলিত হয়ে পড়ি এবং গভীর মনোকষ্ট অনুভব করি। আজ সে কষ্ট লাঘবের পথ উন্মোচিত হয়েছে।
এই প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা ট্রাফিক পূর্বাভাসের দিকে খেয়াল করলেই সকলে সহজেই অনুভব করতে পারবেন। ট্রাফিক পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩ সালে এই সড়কে যানবাহনের সংখ্যা হবে দৈনিক ২৩ হাজার ৯২০টি এবং ২০২৮ সালে দৈনিক ৩০ হাজার ৫৬০টি, ২০৩৩ সালে দৈনিক ৩৯ হাজারটি এবং ২০৪৩ সালে দৈনিক ৬৩ হাজার ৫৮০টি। একবার চিন্তা করুণ তো এখন যানজট শেষ করে হলেও গোন্তব্যে পৌঁছানো যায়Ñ এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হলে ভবিষ্যতে এই এলাকার মানুষের কী পরিমাণ দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হবে? প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণাঞ্চলের যানবাহনগুলোকে ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে হবে না। এসব যানবাহন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচল করতে পারবে। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ জেলার সঙ্গে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অধিক উন্নত ও নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভ্রমণ সময় ৬২ দশমিক ৮৯ শতাংশ কমবে, যানবাহনের গতিসীমা ৪ দশমিক ৪৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে এবং যানবাহনের বিলম্ব সময় ৭৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ কমবে, ইতোমধ্যে যা সমীক্ষায় প্রতীয়মান হয়েছে। পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় হবে ২ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।
সবশেষে ‘মুক্তারপুর ব্রীজ থেকে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ’ প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মুন্সীগঞ্জবাসীর পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা, অভিনন্দন ও অভিবাদন। মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং সড়ক ও সেতু বিভাগের সংশ্লিষ্ট সকল প্রকৌশলী-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থেকো প্রিয় মুন্সীগঞ্জ। ভালো থাকুন প্রিয় মুন্সীগঞ্জবাসী। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।