নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের আবাসিক, ছয়টি ঢালাই ও চুনা তৈরীর কারখানার গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের তিন সপ্তাহের ব্যবধানে তিনিটি গ্রাম ও চারটি ঢালাই কারখানার অবৈধ সংযোগ পুনঃস্থাপনের খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে গজারিয়া উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তিতাস গ্যাস মেঘনা নিউ টাউন কর্তৃপক্ষ। বাউশিয়া ইউনিয়নের বক্তারকান্দী, টেকপাড়া ও মনাইরকান্দী গ্রামের সহস্রাধিক আবাসিক সংযোগ ও বক্তারকান্দী গ্রামে গড়ে তোলা তিনটি ঢালাই লোহা তৈরীর কারখানার গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের তিন সপ্তাহের ব্যবধানে গত মঙ্গলবার পুনঃসংযোগ দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বাউশিয়া ইউনিয়নের মনাইরকান্দী গ্রামের বাসিন্দা ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও গজারিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক কমিটির গ্রাম সরকার উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মোঃ কামাল হোসেনের নেতৃত্বে তিনটি গ্রামের রাইজার ব্যবহারকারী প্রতি পরিবারের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে ওই সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। কামাল হোসেন গতকাল মোবাইল ফোনে গ্যাস সংযোগ পুনঃস্থাপনের কথা স্বীকার করলেও অবৈধ গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলনের কথা অস্বীকার করেন। তিনি আরো জানান, তার সাথে তিন গ্রামের জালাল প্রধান, মহসিন মিয়া, ফারুক হোসেন, শহিদুল হক, বেনজীর আহমেদসহ আরো কয়েকজন ছিলেন।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে মনাইরকান্দী গ্রামের চা দোকানদার আরফিন মিয়ার চা দোকানে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করে চা বিক্রি করা ও পাশের মোস্তফা মিয়ার বাড়িতে গ্যাসের চুলায় রান্নার আয়োজন করতে দেখা গেছে। গজারিয়া উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে ছয়টি ইউনিয়ন জুড়েই রয়েছে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ। মানহীন পাইপ ও সরঞ্জাম দিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গ্যাস সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কারণে ত্রুটিপূর্ণ পাইপ ফেটে গ্যাস উদগীরণ হয়ে অগ্নিকান্ডসহ যেকোন দুর্ঘটনার আশঙ্কায় থাকেন এলাকাবাসী।
সূত্র জানায়, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নকরণ অভিযান পরিচালনা করলেও উচ্ছেদ করা এলাকাসমূহে স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই দেয়া হয় পুনঃসংযোগ। এমনকি প্রকাশ্যে দিনের আলোতেই বিভিন্ন এলাকায় চলে নতুন করে আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপনের কার্যক্রম। সূত্রটি জানায়, অবৈধ সংযোগ গ্রহণকারী বাণিজ্যিক ও আবাসিক গ্রাহকদের শাস্তির আওতায় না আনার কারণেই ব্যবহারকারীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। স্থানীয় সূত্রের দাবী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া অংশের ভিটিকান্দি বাসস্ট্যান্ডের উভয়দিকে একাধিকবার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ অভিযান চালিয়ে ভিটিকান্দি, আলীপুরা ও পৈক্ষারপাড় গ্রামের আট শতাধিক রাইজারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এবং সঞ্চালন লাইনের পাইপ ও সরঞ্জাম জব্দ করলে সংযোগ পুনঃ স্থাপন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবী, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বালুয়াকান্দি এলাকায় ম্যাক ডিক্সের পরিত্যক্ত কারখানার ঝোঁপঝাড়পূর্ণ স্থানে অভিযান চালিয়ে উচ্চ তাপমাত্রায় চুলা ব্যবহার করে চুন তৈরীকরণ ও ঢালাই কারখানার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে কয়েকজন শ্রমিককে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করলেও মূল মালিক রয়ে গেছেন অন্তরালে। ওই অভিযানের বিষয়ে গজারিয়া থানায় তিতাস কর্তৃপক্ষ লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও মামলা রুজু হয়নি অজ্ঞাত কারণে। যার ফলশ্রুতিতে একই মালিক পুনরায় মেঘনা পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় ভাড়া স্থাপনার মধ্যে আবারো অবৈধ গ্যাস সংযোগে তার ঢালাই কারখানা পুনঃস্থাপন করার পর সেখানেও সম্প্রতি অভিযান পরিচালনা করে তিতাস-জোবি কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া অংশের আনারপুরা জামেয়ার পাশের ইউনুস মিয়ার ঢালাই কারখানায় সম্প্রতি অভিযান পরিচালনা করে উচ্ছেদ করলেও আনারপুরা, বড়ইকান্দী, ভাটেরচর নদীর পাড়ে ও নতুনচর চাষী এলাকায় নতুন করে আরো তিনটি ঢালাই লোহা তৈরীর কারখানা স্থাপন করার খবর পাওয়া গেছে। অভিযান ও জেল জরিমানার ভয়ে বালুয়াকান্দী এলাকায় মালিকপক্ষ একটি ঢালাই লোহা কারখানা বন্ধ করে দেয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, আবাসিক সংযোগ ছাড়াও মহাসড়কে ১৫ কিলোমিটার ব্যাপী আনুমানিক ২০টি হোটেল, রেস্তোরাঁয় অবৈধ গ্যাস সঞ্চালন সংযোগ দিয়ে দিনে-রাতে ২৪ ঘন্টা মজাদার বিভিন্ন আইটেমের খাবার রান্না করে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি ভবেরচর বাসস্ট্যান্ডে কেএম সামছুল হুদা সড়কে মক্কা নামের বিশাল রেস্টুরেন্টও চলে অবৈধ গ্যাস সংযোগে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভবেরচর, আনারপুরা ও বালুয়াকান্দি এলাকায় একাধিক রেস্টুরেন্ট অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এছাড়াও মহাসড়কের জামালদী, মেঘনা ও বাউশিয়া পুরাতন ফেরী, ভাটেরচর, ভবেরচর, মধ্য বাউশিয়াসহ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও বাজারসমূহে হোটেল, রেস্তোরাঁয় ব্যবহার করা হচ্ছে তিতাসের অবৈধ সংযোগের গ্যাস। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা হাইরাউজ আবাসিক ভবনে ১ থেকে ২টি চুলার অনুমোদন নিয়ে ব্যবহার করা হয় ১০ থেকে ১৫টি চুলা। এসকল ভবনসমূহে অজানা কারণে কর্তৃপক্ষের নেই কোন তদারকি। বালুয়াকান্দি এলাকায় স্টার কাবাব নামের রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও পুনরায় সংযোগ নিয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সঞ্চালন লাইন ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ বিচ্ছিন্ন সংযোগ পুনঃস্থাপন করে স্থানীয় একাধিক চক্র। অবৈধ গ্রাহকদের সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের পাশাপাশি জেল জরিমানা ও বিভিন্ন ধরনের শাস্তির আওতায় আনা গেলে গ্যাস চুরি প্রতিরোধ সম্ভব হতো বলে স্থানীয় বৈধ গ্রাহকদের দাবী। কালেভদ্রে অবৈধ গ্রাহকদের দু’একজনকে লঘুদন্ডের আওতায় আনা হলেও অধিকাংশই থেকে যায় শাস্তির বাইরে।
গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর বাসস্ট্যান্ডের উভয়পাশে ভবেরচর ও বাউশিয়া ইউনিয়নে দুইটি স্থানের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ভবেরচর বাসস্ট্যান্ডের উত্তর ও দক্ষিণ পাশের বিচ্ছিন্ন করা গ্যাসলাইনে পুনরায় সংযোগ দিয়েছেন স্থানীয়রা।
সোনারগাঁও জোনাল অফিসের আওতাধীন মেঘনা নিউ টাউন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই গজারিয়া উপজেলাব্যাপী টানা অভিযান পরিচালনা করা হবে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে।
সম্প্রতি অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করতে তিতাস কর্তৃপক্ষ সোনারগাঁ এলাকার মেঘনা নিউ টাউন এলাকায় নতুন কার্যালয় স্থাপন করেছে। গজারিয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সোনারগাঁয়ের মেঘনা নিউ টাউন তিতাস গ্যাস কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান পলাম মোবাইল ফোনে জানান, পুনঃসংযোগ দেয়াসহ সব রকমের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ অভিযান চলমান থাকবে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণে।